হজ্ব হল একমাত্র ফরজ ইবাদত যেখানে অর্থনৈতিক ও শারীরিক সামর্থ্য উভয়ই দরকার। যাতায়াতের সুব্যবস্থা ও নানাবিধ সুযোগের কারণে গত কয়েক দশকে হজ্বের শারীরিক কষ্ট ও ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছিল। ফলে এদেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত অনেকেই হজ্ব করে সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারছিল গত কয়েক দশক ধরে।করোনার প্রতিকূল কয়েক বছরের পর হজ্বের ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে এই বছর হজ্বের যে ব্যয় ঠিক করা হয়েছে তাতে অনেকেই হজ্ব করতে পারবে বলে মনে হয় না। এ ব্যয় আগের হজ্ব তথা ২০১৯ সালের তুলনায় অনেকটা দিগুণের কাছাকাছি। করোনা মহামারীর আগের হজ্ব তথা ২০১৯ সালে মধ্যবিত্তের ইকোনমি প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার এর কম বেশি। এখন ইকোনমি প্যাকেজ এর খরচ সর্বমোট ৭ লাখ টাকা বা এর কম বেশি। যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের সরকারকে বিমান ভাড়াসহ হজ্বের আনুসঙ্গিক ব্যয় কমাতে হবে। অপরদিকে ৫ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে তাবু, বাস ভাড়াসহ সৌদি আরবে হজ্বের আনুষঙ্গিক খরচ কমিয়ে আনতে হবে।মনে হয় না সৌদি সরকার হজ্বের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছে। হজ্ব ও ওমরাহ দ্বারা সৌদি সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। কাজেই ৫ দিন ব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে ব্যয় কমাতে তাদের অজুহাত থাকতে পারে না। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। এ উদ্যোগে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান একমত হয়ে সমর্থন সহযোগিতা যোগাবে। সাথে তুরস্ক মিশরসহ যে সমস্ত দেশে হজ্বযাত্রী সংখ্যা বেশি তাদের সহযোগিতা নেয়া যায়।করোনার আগে চূড়ান্ত নিবন্ধন শুরু হতেই কদিনের মধ্যে অনেকটা কোটা পূর্ণ হয়ে যেত। আর এখন চূড়ান্ত নিবন্ধনে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যারা আগে থেকে প্রাক–নিবন্ধন করে রেখেছে তাদের তা ধারণা ছিল না হজ্ব করতে এত ব্যয় হবে।বিশ্বে ওমরাহ এর ইতিহাস শত বছরেও নয়। হজ্ব ও ওমরাহকারীগণ আল্লাহপাকের আমন্ত্রিত মেহমান। হজ্বের পাশাপাশি ওমরাহও ধর্মীয় সফর। শত বছর আগে যোগাযোগ নিরাপত্তা ও নানান প্রতিকূলতায় হজ্ব করা দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। সে সময় দূরের দেশ থেকে ওমরাহ এর কথা ভাবাই যেত না। ওমরাহ করতেন অল্প সংখ্যক লোক। তারা হতেন অনেকটা হেজাজ বা হেজাজের নিকটতম স্থান থেকে। কিন্তু বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধারণাতীত উন্নতি লাভ করায় মানুষ ওমরাহর দিকে ঝুঁকতে থাকে। করোনা মহামারীতে হজ্বের ২ বছর এবং ওমরাহ সময় বিদেশ থেকে গমন বন্ধ ছিল। অতঃপর ওমরাহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ নর–নারী ওমরাহ ও যেয়ারত উপলক্ষে সৌদি আরব প্রবেশ করছে। সৌদি সরকারও ওমরাহ এর ক্ষেত্রে আইন কানুনে আরও শীতলতা আনে। অর্থাৎ ওমরাহ উপলক্ষে ৩ মাস অবস্থান করা যাবে, সৌদি আরবের যে কোনো স্থান গমন করা যাবে। ওমরাহ এর ক্ষেত্রে সৌদি আরবের খোলামেলা সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজারের অধিক নর–নারী ওমরাহ ও যেয়ারত উপলক্ষে সৌদি আরব গমন করছে, যা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ২০/৩০ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না।ওমরাহ এর ইকোনমি প্যাকেজ ১ লাখ ৩০/৪০ হাজার টাকা। ২ সপ্তাহের এ প্যাকেজে যাওয়া–আসা বিমান ভাড়া, পবিত্র দুই নগরীতে থাকা–খাওয়া যাতায়াত ইত্যাদি। ফলে সাধারণ নর–নারীদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এসে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অর্থাৎ হজ্ব করা যখন অত্যধিক ব্যয়বহুল, অন্তত ওমরাহ এর উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় গমন করে সৌভাগ্যবান হওয়া।যদিওবা ওমরাহ হল সুন্নাত। হজ্ব হল একাধিক শর্ত সাপেক্ষে ফরজ। ৭০ বার ওমরাহ করলেও হজ্ব ফরজ থেকেই যাবে।বিশ্বে হজ্বে গমনকারীর সংখ্যার দিক দিয়ে ১ নাম্বার ইন্দোনেশিয়া, ২ নাম্বার ভারত, ৩ নাম্বার পাকিস্তান, ৪ নাম্বার বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশ উদ্যোগ নিলে অন্যান্য মুসলিম দেশ সমর্থন জানাবে। এতে প্রচেষ্টা চালালে সৌদি সরকার ব্যয় কমিয়ে আনবে বলে মনে করি।অপরদিকে বিমান হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। গত বছর হিসাবে লাভ দেখিয়েছে। মিশর থেকে বিমান কিনতেই নাকি হাজারের অধিক কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে, বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিমান নিয়ে কত রকমের দুর্নীতির কথা শুনা যায়। হজ্বের ক্ষেত্রে মনে হয় বিমান সুযোগ পেয়ে বসে। মনে হয় ন্যূনতম ছাড় দিতে চায় না। জানি না অন্যান্য খাতের লোকসান হজ্বযাত্রীর মাধ্যমে পুষিয়ে নিতে চায় কিনা।এমনিতেই ওমরাহ এর ক্ষেত্রে বিমানের ভাড়া ১৫/২০ হাজার টাকা বেশি। মনে হয় সৌদি এয়ার লাইন্স বিমানের দিকে চেয়ে থাকে যাতে বর্ধিত ভাড়ার সুযোগটা নেয়া যায়।প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বাংলাদেশ বিমান বন্দরে হজ্বযাত্রীরা পৌঁছালে বা রিপোর্ট করলে একটা খাবার প্যাকেট দেয়া যেতে পারে। তেমনিভাবে হজ্বের পর সৌদিতে হজ্ব টার্মিনালে রিপোর্ট করলে একটি খাবার প্যাকেট দিতে পারে। অবশ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে হজ্বে গমনকালে একাধিক শিল্পপতি, গ্রুপ অব কোম্পানী খাবার প্যাকেট দেয়া চালু রেখেছে। তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।আজ থেকে শত বছর আগেও হজ্বযাত্রীর সংখ্যা ছিল লাখের কম বেশি। এর মূলে হল যোগাযোগ প্রতিকূলতা। সেকেলে প্রযুক্তিতে সাগরপথে ভারতবর্ষসহ ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ার লোকজন হজ্বে যেতেন নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে। সে সময় ছোট, সেকেলে প্রযুক্তির জাহাজ সাগর মহাসাগরে প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকে থাকা কঠিন থাকত। স্বল্প সংখ্যক যারা যেতেন তারা চিরতরে বিদায় নিয়ে যেতেন। ফিরে আসতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। হেজাজের উত্তর পার্শ্ববর্তী বিশ্বের প্রাচীনকাল থেকে সমৃদ্ধ অঞ্চল মূলকে শাম। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি সুলতানগণ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটিশ ফ্রান্সের তৎপরতায় ভাগ বাটোয়াটা হয়।ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডানসহ ৬/৭ দেশ এ মূলকে শামের ভাগ পায়। হেজাজে আসতে মূলকে শামের প্রধান জংশন দামেস্ক। দামেস্ক থেকে পবিত্র মদিনায় আসতে ১৪৬৪ কি.মি দূরত্বে ৪০ দিন সময় লাগত। তা আবার নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (স.)’র বিদায় হজ্ব থেকে শুরু করে শত বছরের আগ পর্যন্ত হজ্বযাত্রীর সংখ্যা লাখের কম বেশি থাকত। যুদ্ধ বিগ্রহ মহামারীর কারণে মাঝে মধ্যে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা একদম কমে যেত।আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অত্যাধুনিক বিমানে অতি আরামে জেদ্দা অথবা পবিত্র মদিনা বন্দরে নামতেছে। ১–২ দশক আগে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩০/৪০ লাখ। সৌদি সরকার কড়াকড়ি আরোপ করায় ২৬ লাখে এসে দাঁড়ায়। আগামী জুনে (২০২৩) হজ্বে প্রায় ২৬ লাখ নর–নারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হজ্বে যাবেন।গত জানুয়ারিতে তাবলীগ জামাতের ইস্তেমায় একাধিক বেসরকারি টিভি ইস্তেমায় আগতের সাক্ষাৎকার নেয়। এতে আগতদের একাধিক ব্যক্তি বলছে, হজ্বে যেতে এত টাকা পাব কই। টঙ্গী এস্তেমায় এসে হজ্বের তৃপ্তি লাভ করছি।আশা করব আমাদের সরকার হজ্বযাত্রীর প্রতি আরও সদয় হবে বিমান ভাড়া কমাবে ও সৌদি সরকার যাতে হজ্বের ব্যয় কমায় সে লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাবে।লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট
Make sure you enter the(*)required information