পবিত্র মদিনায় মসজিদে নববীর দক্ষিণ দিকে (কিবলার দিকে) কিছুটা পশ্চিমে মাত্র শত মিটারেরর মধ্যে দুই মিউজিয়াম পাশাপাশি দাড়িয়ে রয়েছে। যা মসজিদে নববীর দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।পূর্ব পশ্চিম লম্বা মিউজিয়াম দালানটি উত্তর পাশে ডিজাইনটা ব্যতিক্রমধর্মী। কাজেই এক তলা এ দালানে যে ব্যতিক্রম কিছু তা দূর থেকে অনুধাবন করা যায়।৮-১০ বছর বা তারও আগে মসজিদে নববীর পশ্চিম পাশে মিউজিয়াম ছিল। বৃহত্তর পরিসরে এ দালানটি এখন পরিত্যক্ত। দালানের পূর্ব দিকে মিউজিয়াম শব্দটি থেকে থাকায় আমার মত অনেকে বিভ্রান্ত হবে স্বাভাবিক। ৮/১০ বছর এর মত সময়ে দক্ষিণ পাশের এ মিউজিয়ামে করোনার আগেও যাওয়া হয়েছে। গত ২০২১ সালের অক্টোবরেও যাওয়া হয়েছিল। তখন আমাকে রিয়াল উল্লেখ করে টিকেট দিল। কিন্তু রিয়াল তথা টাকা নিল না।মিউজিয়ামে সাধারণত মাগরিবের পরেই যাওয়া হয়। যেহেতু মসজিদে নববী থেকে ৩/৪ মিনিট সময়ে পৌঁছা যায়। গত নভেম্বরে পবিত্র মদিনায় যেয়ারতের উদ্দেশ্যে অবস্থানকালে এইবারও যাব যাব মনে করে ১০/১২ দিন পার হয়ে গেল। সম্ভবত ১৯ নভেম্বর শনিবার মাগরিবের নামাজের পরপরই মিউজিয়ামে চলে গেলাম। দুই দিকের মিউজিয়ামের মধ্যখানে টিকেট কাউন্টার। এক মিউজিয়ামে ১৫ রিয়াল আরেক মিউজিয়ামে ৩৭ রিয়াল। ১৫ রিয়ালের টিকেট নিয়ে পশ্চিমপাশে মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৫/৭ টি ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যেয়ারতকারীগণকে প্রবেশ করায়। এখানে বাংলা বর্ণনাকারীর ব্যবস্থা নেই। মাগরিবের পরপর উর্দু বর্ণনাকারীর সেশন। বাংলাদেশী মনে হয় আমি একা। বাকী সবাই ভারত পাকিস্তান এবং ইউরোপ থেকে আসা উর্দু ভাষাভাষি মিলে আমরা ১৫/২০ জন হব। গাইড আমাদেরকে উর্দুতে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। এই মিউজিয়ামে মসজিদে নববীর ইতিহাস। আল্লাহর রাসূল (স.) পবিত্র মদিনায় হিজরতের পর মসজিদে নববীর স্থানটি কি রকম ছিল, মাটির দেয়াল ও খেজুরের বিম সহযোগে কিভাবে ছাদ দেয়া হল, এসব কিছুর কাল্পনিক ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছে। বর্ণনাকারী বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। এরপর আল্লাহর রাসূল (স.) এর ওফাত হল অতঃপর হযরত আবু বকর (র.) ও হযরত ওমর (র.) ইন্তেকালের পর এখানে শায়িত হলেন তা পবিত্র তিনটি কবরের কাল্পনিক নমুনা প্রদর্শন করা হচ্ছিল। এরপর হযরত ওসমান ও ওমাইয়া আমলে মসজিদে নববী পরিবর্তন পরিবর্ধন হল তারও কাল্পনিক ছবি প্রদর্শন করা হয়। এরপর আমাদেরকে তুর্কি আমলের মসজিদে নববী কি রকম ছিল তা প্রদর্শন করে। এখানে বর্তমান তুর্কি হেরেমের উত্তরপাশে বাদশাহ আবদুল আজিজ হেরেমের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমার প্রশ্নে বর্ণনাকারী বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। যেহেতু বর্তমান তুর্কি হেরেমের উত্তরপাশে আবদুল আজিজ হেরেম ১৯৫০ এর দশকে করা হয়েছে তুর্কি হেরেমকে ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু তুর্কি হেরেমের এ মডেলটি আমি ইস্তাম্বুলের তোপকাপি যাদুঘরে দেখেছি। এতে বর্ণনাকারী বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। যেহেতু তার বয়স ৩০/৩৫ বছর হবে। কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলেছেন বা ধারণা দিয়েছেন সেভাবেই তিনি বলে যাচ্ছেন। মিউজিয়ামের সর্বশেষ কক্ষে বর্তমান মসজিদে নববী প্রদর্শন করা হচ্ছে। এ কক্ষের এক পাশের দেয়ালে প্রায় শত বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন সময়ে মসজিদে নববী পবিত্র মদিনাসহ ৮/১০ টি ছবি প্রদর্শন করছে, যা কাল্পনিক নয়, বাস্তব। এ ছবিগুলোর এলবাম চেয়েছিলাম, পেলাম না। অর্থাৎ শত বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন সময়ের ৮/১০ টি ছবি তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। ১৪ শত বছরের ব্যবধানে প্রদর্শন করা যাবতীয় কিছু কাল্পনিক।প্রায় ৪০/৪৫ মিনিটের এই উর্দু বর্ণনা দিয়ে এ সেশন শেষ হয়ে যায়। আমিও দ্রুত মসজিদে নববীতে চলে যাই এশারের জামাতের উদ্দেশ্যে। পরের দিন তথা ২০ নভেম্বর রবিবার মাগরিবের নামাজের পর পর পুনঃ গমন করি পূর্বপাশে মিউজিয়াম দেখতে। এখানে কাউন্টার থেকে বলা হল এখন শুরু হচ্ছে অন্য ভাষায়। বাংলা ভাষা নেই, এশারের পর পর ৭ টা ৫০ মিনিটে উর্দু ভাষায় বর্ণনা আছে। তখন আমি ৩৭ রিয়াল দিয়ে টিকেট নিলাম ৭ টা ৫০ মিনিটের। প্রায় ৭ টা ১০ মিনিটে এশারের আজান। আমি টিকেট নিয়ে মসজিদে নববীতে চলে এলাম। এশারের পর পর মিউজিয়ামে চলে আসি। পূর্বপাশের মিউজিয়ামের গেইটে আমাকে প্রবেশ করায়ে নিল। দেখলাম ভারত পাকিস্তান ইউরোপের মাত্র ১০/১১ জন হবে। বাংলাদেশী বা বাংলা ভাষাভাষি আমি একজন। গতকালকে বর্ণনাকারী যে আরবীয় নয় ভারত বা পাকিস্তানী, শারীরিক আকৃতিতে বুঝা যাচ্ছিল। আজকের বর্ণনাকারীকে ড্রেসে আরবীয় মনে হচ্ছিল। আজকের এই মিউজিয়াম পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনারসহ ছবির মাধ্যমে ইসলামের নানাবিধ বর্ণনা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রায় অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়ে দিলেন ইসলামের ধর্মীয় বর্ণনা দিয়ে। তৎমধ্যে কুরাইশ বংশ, আল্লাহর রাসূল (স.) এর জীবন, পারিবারিক সন্তান-সন্তানাদিসহ ধর্মীয় নানান কিছু। যে সব ধর্মীয় জ্ঞান কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ধর্মীয় কিতাবাদিতে পাওয়া যায় এসব কিছু এখানে বর্ণনা না করে অজানা নতুনত্ব কিছু দিতে পারলে ভাল হত।যেমনটা ২০১৯ সালে হজ্বের প্রায় ২ সপ্তাহ পর পবিত্র মক্কায় আসরের নামাজের পর ১৫০ রিয়াল দিয়ে টিকেট কেটে ক্লক টাওয়ারে উঠেছিলাম। আমার সাথে ৮/১০ জন ছিল। তারা এখানে বর্ণনা দিয়েছিল সৌরজগতের সাথে ইসলামের সম্পৃক্ততা। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফে কি বলা হয়েছে। যে সব বিষয় কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ ইন্টারন্টে থেকে জানা যায়, সেসব কিছু প্রদর্শন, বর্ণনা না দিয়ে ১২০/১৪০ তলার এ ক্লক টাওয়ার কিভাবে নির্মিত হল, বিশ্বখ্যাত এ ঘড়ি কোন দেশ থেকে কিভাবে আনল, কিভাবে লাগাল এসব কিছু দেখার জানবার জন্য, বুঝবার জন্য ত এখানে আসা। কিন্তু তার কোন কিছুই ছিল না। এখানে ১১ ভাষায় কানে হেডফোন দিয়ে শুনবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষা নেই। নিচে এসে কাউন্টারে প্রতিবাদ করি। মুদির (পরিচালক) এর সাথে আলাপ করতে অতী আগ্রহ দেখাই। তারা আমার নাম্বার রাখে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে মোবাইল করে জানায় অতিসত্তর বাংলা সংযুক্ত করা হবে। মূল কথায় ফিরে আসি। প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সময়ের পর তারা মক্কা শরীফ ও মদিনা শরীফের কাল্পনিক চিত্রসহ নানান বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কাল্পনিক চিত্রের মাধ্যমে নবী পাক (স.) এর হিজরতের বর্ণনা দেন।অতঃপর ৬০/৭০ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ছোট হলে প্রবেশ করাল। এখানে আমরা ১০/১২ জন বসলে লাইট বন্ধ করে দেয়। সামনে বিশাল স্ক্রিনে মহান আল্লাহপাকের সৃষ্টির বিশালত্ব সৌরজগতের নানা কিছু নিয়ে ৮/১০ মিনিট প্রদর্শন করে। অতঃপর আরেক কক্ষে নিয়ে যায়। এখানে নবী পাক (স.) এর ব্যবহৃত টুপি, লাঠি, তলোয়ার ইত্যাদির কাল্পনিক চিত্র প্রদর্শন করছে। ৪০/৪৫ মিনিটের উর্দু অধিবেশনের এখানে সমাপ্তি। আমাদের পেছনে তুর্কি ভাষার বর্ণনাকারী লোকজনকে নিয়ে আসতেছিল। ঐ গ্রুপে ২০/২২ জন হবে দেখা যাচ্ছে। আমাদের বর্ণনাকারী থেকে জানতে চাইলাম তার দেশ কোথায়? পাকিস্তানের লাহোরে বললেন। আমার প্রশ্নে তিনি জানান ৬/৭ ভাষায় এভাবে অধিবেশন চলে। বাংলা ভাষা নেই। এরপর সর্বশেষ বিক্রয় কেন্দ্রে আসলাম, বইপত্রসহ নানান দ্রব্য সামগ্রী সাজিয়ে রাখা আছে। বিক্রেতাগণ থেকে জানতে চাইলে বাংলা ভাষায় কোন বই পুস্তক নেই বলল।বস্তুতঃ মসজিদে নববীর দক্ষিণ দিকে চত্ত্বর সংলগ্ন এ দুটি মিউজিয়াম যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে বলা যাবে। যেহেতু সব সময় লাখের উপরে যেয়ারতকারী রওজাপাকের নিকটে হোটেল সমূহে অবস্থান করছেন। তারা যেয়ারত ও ৫ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে আরও যাতে জ্ঞানার্জন করতে পারে সে লক্ষ্যে এ দুটি মিউজিয়াম।বিদেশ থেকে হজ্ব ওমরাহ যেয়ারতকারীগণ সৌদি আরবে প্রবেশ করা মানে সৌদি রাজতন্ত্রীয় সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। এখানে মিউজিয়ামের একটিতে ১৫ রিয়াল, আরেকটিতে ৩৭ রিয়াল নেয়া হচ্ছে। প্রবেশ মূল্য নেয়া আমি মনে করি গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে প্রবেশ মূল্য না রাখাই শ্রেয়। রাখলেও সর্বোচ্চ ৫/১০ রিয়াল রাখা যেতে পারে। যাতে যেয়ারতকারীগণ আসুক, দেখুক, জানুক।আর যে সবকিছু কুরআন শরীফে, হাদীস শরীফে বা ইন্টারনেট থেকে জানা যায়, সে সব কিছুর জন্য সময় ক্ষেপন না করে নতুনত্ব আরও কিছু সংযোজন করতে পারলে ভাল হবে।আগেই অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, সৌদি সরকারের অনুরোধে ইস্তাম্বুলের তোপকাপি যাদুঘরে তবরুকাত প্যালেস থেকে কিছু কিছু তবরুকাত এখানে এনে এ দুটি মিউজিয়াম সযত্মে রাখলে মিউজিয়ামের গুরুত্ব কতই না বাড়বে! তখন প্রতিদিন হাজার হাজার যেয়ারতকারী লাইন ধরবে এখানে আসার জন্য।আশা করি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ভাববে।ক্যাপশন: মসজিদে নববীর চত্বর সংলগ্ন মিউজিয়ামের সম্মুখভাগ।
Make sure you enter the(*)required information