বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত এই গানটি "কোক স্টুডিও সিজন-টু"-তে নিবেদিত হয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষা এবং খুলনা ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় (dialect) গানটি গাওয়া হয়। গানটির মূল উপজীব্য থিম চট্টগ্রামের কালুরঘাট হতে বহদ্দারহাট পর্যন্ত চলাচল করা পাবলিক বাসের যাত্রী পরিবহন ভিত্তিক রচিত। মূল গানটি চট্টগ্রামের ভাষায় এবং দুটি রেপ ভার্সন সিলেট (মূলতঃ মৌলভীবাজার) ও খুলনার (মূলতঃ যশোর) আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া হয়েছে। রিয়াদ (চট্টগ্রাম), পল্লব (সিলেট) ও তৌফিক (খুলনা) গানটির মূল ভোকাল। গানটিতে অঞ্চল ভিত্তিক কিছু মৌলিক পরিচিতি উঠে এসেছে। যেমন: খুলনার চুই ঝাল, চট্টগ্রামের কালুরঘাট ইত্যাদি। সিলেটি ভাষার রেপ ভার্সনের চটুল তাল/ছন্দ দ্রুত হতে ধীর লয় এ রূপান্তর অর্থাৎ রিদম্ সুইচিং এর বিষয়টি বেশ আকর্ষণীয় ছিল। সিলেট ও খুলনার ভাষা কিছুটা বোধগম্য হলেও চট্টগ্রামের লোকজন ছাড়া বাংলাভাষী অন্যান্যদের নিকট গানটির বোধগম্যতা কতটুকু ছিল তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে গানটির মিউজিক কম্পোজিশন (শুভেন্দু দাস শুভ) ও স্টেজ সেটআপ এর বিষয়টি চটকদার ছিল বলা চলে। মুল গানের মাঝে হেলপারের সাজে চতুর্থ গায়কের (মিথুন চরকা) সেকেন্ডারি ভয়েস গুলো দৃষ্টি আকর্ষণীয় ছিল। "কোক স্টুডিও" এপিসোড গুলোর এমনিতেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রিভিউ হয়ে থাকে। আমি ইউকে, জার্মানি, ভারত ও পাকিস্তান সহ আরো কয়েকটি দেশের রিভিউ শুনেছি। ভারত ও পাকিস্তানের রিভিউগুলোতে গানটির লাইন বাই লাইন এক্সপ্লেইন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন রিভিউয়ার গানটির লিরিক্স অনুধাবন করতে পারেননি কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে হেলাফেলা করেছেন বলে মনে হয়েছে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশী একজন রিভিউয়ার কোন ভাষায় গানটি গাওয়া হয়েছে তাই জানেন না বলে মন্তব্য করেন। যদিও চাটগাইয়া ভাষার এক্সট্রিমলি অরিজিনাল কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তারপরও বাংলাদেশের লোক হয়ে চাটগাইয়া ভাষা চিহ্নিত করতে না পারাটা বেশ দুঃখজনক। অন্যান্য দেশের রিভিউয়াররা গানের লিরিক্স এড়িয়ে গিয়ে মিউজিক কম্পোজিশন, পার্কাসন্স ভ্যারাইটি, ড্রেস কোড, স্টেজ সেট আপ ও ওভারঅল ডেকোরেশন ইত্যাদি বিষয়ে হাইলাইট করেছেন। একজনকে তৌফিক নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে প্রায় হিমশিম খাচ্ছিলেন দেখতে পেলাম। একজন রিভিউয়ার ড্রেস কোড ও স্টেজ ডেকোরেশন এ লালের অতিরিক্ত সমারহের সমালোচনা করেছেন। অবশ্য কোকাকোলার মনোগ্রাম কালারের সাথে মিলিয়ে ডেকোরেশন কালার কোড মেইনটেইন করা হয়েছে বলে আমার ধারণা। কেউ কেউ গানটির ব্যাকগ্রাউন্ড বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে, যদিও বিস্তারিত বুঝাতে পারেননি। গানের মূল স্ট্রাইকিং লিরিক্স হালুরগাইট্যা মুড়ির টিন এর সঠিক ব্যাখ্যা আসেনি বলা যায়। মুড়ির টিনের দুই ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে অর্থাৎ মুড়ি যা ইংরেজিতে 'পাফড্ রাইস' হিসেবে পরিচিত একটি টিনের মধ্যে রাখা হলে গাদাগাদি অবস্থায় থাকে, ঠিক তেমনি শহর এলাকার বাসগুলোতে যাত্রীরা মুড়ির মতো গাদাগাদি অবস্থায় থাকে, যে কারণে এগুলোকে মুড়ির টিম অভিহিত করা হয়। সামনে ইঞ্জিন বনেট সহ অথবা বনেট বিহীন কাঠ বডি (পরে কিছু স্টিল বডির বাস ছিল) বাসগুলো অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো, কালুরঘাট একটি জায়গার নাম যা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই বিখ্যাত অথচ রিভিউয়ারদের আলোচনায় এটি উঠে আসেনি। আরো দুঃখজনক হলো বাংলাদেশের রিভিউয়াররা গানটির লিরিক্স ভিত্তিক পূঙ্খানুপূঙ্খু ব্যাখ্যা করতে পারেননি। যাই হোক বাংলাদেশের তিনটি ঐতিহাসিক অঞ্চলের ভাষা নিয়ে সমৃদ্ধ গানটি বেশ উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় ছিল নিঃসন্দেহে। আমি গানটিতে বিমোহিত হয়েছি, গানটির গায়কদের প্রতি আমার অন্তরের অন্ত:স্থল হতে ধন্যবাদ। আমি নিজে চট্টগ্রামের অধিবাসী, একজন চাটগাইয়া হিসেবে আমি গর্বিত। চট্টগ্রামের ভাষা বাংলা ভাষাভাষী অনেকের নিকট দুর্বোধ্য মনে হলেও এটি বিশ্বের ১০০ টি মূল ভাষার মধ্যে অন্যতম। এক কোটিরও বেশি লোক চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিত্ব এই ঐতিহাসিক ভাষাভাষী। বিশেষত গায়ক ও ছোট-বড় পর্দার শিল্পীদের অনেকেই চাটগাইয়া ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী। এছাড়াও রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বহু গুণী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, গবেষক, বিজ্ঞানী, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ। আশা করি চট্টগ্রামের আপাত দুর্বোধ্য ভাষা একসময় সকলের নিকট বোধগম্য হয়ে উঠবে। অবশ্য বুঝুক বা না বুঝুক আমাদের চাটগাবাসীর মনের ও হৃদয়ের এই ভাষা চিরকাল বহমান থাকুক এই কামনাই করি ।।ওয়াহিদ আজাদ ; ০৩-০৬-২৩
Make sure you enter the(*)required information