Login Sign Up Subscription Forgot Password
Chunati.com
  • Home
  • Chunati Barta
  • Who's Where
  • Books
  • Writer's Column
  • History
Latest Update
  • চুনতি সমিতি ঢাকার ২০২৫ সালের শিক্ষাবৃত্তির আবেদন আহ্বান
  • বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম জেলার নতুন পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন শাকিলা সোলতানা
  • বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও আইআইইউসি চট্টগ্রামের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আবু বকর রফিক আহমদ, চুনতি ফাতেমা বতুল মহিলা ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি মনোনীত
  • এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসের সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ
  • ।। দাদা-দাদী বৃত্তান্ত ।।
  • ব্যবহারিক বিজ্ঞান উৎপত্তি ও বিকাশ
  • রমজানের বরকত
  • চুনতি
  • স্মৃতিময় মেলবন্ধন বনাম বার্ষিক পিকনিক আয়োজন
  • Siratunnabi (SM)
  • Blood Bank
  • Illustrious Person
  • Events & Happening
  • Gardens of Remembrance
  • Sher Khani
  • Send Your Profile
  • Photo Album
  • Video Channel

চুনতী : আমার শেখড়ের সন্ধানে

জওশন আরা রহমান

চুনতী আমার শেখড়। আমার জন্মভূমি।আমার তীর্থভূমি । কালে কালে চুনতিতে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক উচ্চপদস্থ  সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা জন্মগ্রহণ করেছেন। চুনতীর  কৃতি সন্তান নারী-পুরুষ আমাদের সুপ্রিয় জন্মভূমির জন্য অজস্র সম্মান এবং প্রশংসা অর্জন করেছেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে তারা স্বীকৃতি লাভ করেছেন। চুনতীকে সকলের কাছে সুপরিচিত করেছেন। তাই চুনতীর প্রবীণ-নবীন প্রজন্ম এবং আমার পূর্বসুরিদের প্রতি জানাই অশেষ শ্রদ্ধা আর শুভ ইচ্ছা ।

আমার সুদীর্ঘ  জীবনে অতি অল্প সময় চুনতীতে কাটাবার সুযোগ পেয়েছি । আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার সৌভাগ্য আমার হয়নি । অথবা নাগরিক জীবনের গোলক ধাঁধায়  একাত্ম হয়ে যাওয়ার কারণে চুনতী সম্পর্কে বিশেষ তথ্য জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি । তাই চুনতীর ঐতিহ্যের বিস্তারিত তুলে ধরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আমি এখন আমার ঐতিহ্যের সন্ধানে স্মৃতির পাতায় ফিরে যাচ্ছি। কক্সবাজার যাবার পথে যেখানে লাল মাটি শুরু হয়েছে সেখানে সবুজ পাহাড় ঘেরা আমার গ্রাম। চুনতীর পাহাড়, প্রতিটি ধূলিকণা ধরে রেখেছে আমাদের ঐতিহ্য ।বিশাল বৃক্ষরাজীর  সুশীতল ছায়াঘেরা  পাহাড়ে শায়িত আছেন   আমাদের পূর্বসুরিরা যুগ যুগ ধরে।আর চুনতির  সন্তানদের জন্য অবিরাম করে চলেছেন আশীর্বাদ যা নিয়ে  চুনতী অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে ।তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বার বার আমার মন ফিরে যেতে চায় স্মৃতির সন্ধানে। ঐতিহ্যের সন্ধানে। আমাদের পূর্বপুরুষ কারা? আমরা কিভাবে কোথা থেকে চুনতি আসলাম? কিভাবে এখানে বসতি স্থাপন করলাম? এসব প্রশ্ন মনের গভীরে মাঝে মাঝে ঢেউয়ের পাহাড় নির্মাণ করে। আমাদের পূর্বসুরিরা যে মহামূল্যবান অবদান রেখে গেছেন বিশেষ করে তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের নিবেদন।

"আমাদের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল চুনতীর শিকদার পাড়া। শিকদাররা মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনের সময় থেকে আমলাদের  খাজনা  আদায়ের কাজে সাহায্য করতেন। আওরঙ্গজেবের সিপাহশালার মীর জুমলার অধীনে ফজর আলী খান ছিলেন  একজন সেনা কমান্ডার ও প্রশাসক। তাদের এজেন্ট ছিলেন শিকদাররা। কালু শিকদার ছিলেন তাদের একজন। তার বংশধর আমানত আলী শিকদার,গণি শিকদার, সমদ আলী শিকদার। আমরা তাদেরই বংশধর।"

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে চুনতীতে মাওলানা আব্দুল হাকিম ও তার ভাই নাসিরউদ্দিন ডিপুটি এবং শকুর আলী মুন্সেফ এর মত অসাধারণ তিনজন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন। নাসিরউদ্দিন শিকদার পাড়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে  এবং শকুর আলী মুন্সেফ উত্তর দিকে বসতি  স্থাপন করেন যথাক্রমে ডেপুটি পাড়া ও মুন্সেফ  পাড়া।

এই তিন ব্যক্তির পুত্র কন্যাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। নাসিরউদ্দিন ছিলেন বনিয়াদি জমিদার এবং অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ  উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা । সুশাসক নাসিরউদ্দিন ডেপুটি নামে তার পরিচিতি সর্বত্র। শকুর আলী মুন্সেফ ছিলেন একজন সুবিচারক। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও আপোষহীন । আমার শ্রদ্ধেয় জেটা শ্বশুর রাউজান থানার গহিরা নিবাসী মরহুম নূর আহমেদ চৌধুরী ১৯৫০ দশকের শেষের দিকে আমাকে এবং আমার স্বামী মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে একটি উপাখ্যান বলেছিলেন যখন শুনলেন আমি শকুর আলী মুন্সেফের বংশধর । উপাখ্যানটি এমন : কথিত আছে শকুর আলী মুন্সেফ রাউজানে চাকরিরত অবস্থায় একবার পাল্কী ভ্রমণে বের হয়ে সাক্ষাত পান এক বিধবা নারীর। তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। শকুর আলী মুন্সেফ পালকি থামিয়ে তার কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। অসহায় নারী দু চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, নদীর ভাঙ্গনে তার বাস্তুভিটা  ভেসে গেছে। নদীর অপর পাড়ে যে পতিত জমি তাতে তিনি কোন অংশ পাবেন না। আইনের ফাঁদে আটকা পড়ে তিনি গৃহহীন,সম্বলহীন। শকুর আলী মুন্সেফ তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে তাকে কিছু টাকা দিলেন। কিন্তু এরূপ ন্যায়নীতিহীন আইনের বিরুদ্ধে তার অন্তর বিদ্রোহ করল। বহু চেষ্টা করেও  তারপর প্রাপ্য জমির ব্যবস্থা করতে পারলেন না। এই যন্ত্রণায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। এ প্রমাণস্বরূপ কোন তথ্যসূত্র আমার জানা নেই। তবে শকুর আলী মুন্সেফের মধ্যে একজন ন্যায়পরায়ণ এবং কল্যাণমুখী মানুষের জন্য উক্ত ঘটনা  অবিশ্বাস্য নয়।

জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি মুন্সেফের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং আধ্যাত্বিক সাধনায় পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।

আমার প্রপিতামহ শকুর আলী মুন্সেফের দেশজুড়ে খ্যাতি ছিল । বিভিন্ন কর্মস্থানে তার নামে মসজিদ, বাজার ও রাস্তাঘাট এখনো বিদ্যমান। পটিয়ার প্রধান সড়ককে শকুর আলী মুন্সেফ বাজার বলে নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া চুনতি বাজার, পোস্ট অফিসও তার নামে আছে। চট্টগ্রাম শহরে আমাদের বাস্তভিটায় যাবার  যে রাস্তা তার নাম শকুর আলী মুন্সেফ লেইন। "১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদার দাতারাম চৌধুরী রাউজানের সুলতানপুরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে শকুর আলী মুন্সেফ রাউজানে চাকরিরত অবস্থায় এই স্কুল রাউজান থানা সদরের স্থানান্তর করেন এবং মিডল স্কুলে রূপান্তরিত করেন । পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে এটি রাউজান হাইস্কুলে উন্নীত হয়।"

প্রপিতামহ আমাদের জন্য একটি মহান আদর্শ ও ঐতিহ্য রেখে গেছেন। তাহলো সততা, কুসংস্কারমুক্ত ধর্ম প্রবণতা,ন্যায় বিচার ও ন্যায় পরায়ণতা । তিনি সারা জীবন শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তিনি কেবল একজন ন্যায় বিচারক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন না, একজন সুফি দরবেশ হিসেবে ও খ্যাত ছিলেন । আমরা এই মহর্ষির বংশধর। এর মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য ।

চুনতিতে আমাদের বাড়ি মুন্সেফ বাড়ি এবং নানার বাড়ি ডেপুটি বাড়ি নামে পরিচিত। আমাদের বাড়ির পেছনে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিরাট এক হাওর ছিল। তাতে ফুটে থাকতো  অসংখ্য পদ্মফুল। বাড়ির সম্মুখে প্রপিতামহ শকুর আলী মুন্সেফ এর দেওয়া চারপাশে আম গাছ ঘেরা বিরাট এক পুকুর । এর এর পাড়ে দাঁড়ালে  দেখা যায় পূর্ব দিকে সবুজ ধানের ক্ষেত  । ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাঝে মিলিয়ে গেছে।

সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন শকুর আলী মুন্সেফ এর সুযোগ্য পুত্র। আব্বা মাহবুবুর রহমান ছিলেন সিদ্দিকুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র। আমার পিতামহ সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন তৎকালীন একজন দক্ষ স্বনামধন্য কাজী। দাদা এবং নানা ছিলেন দুই বন্ধু। তার স্বাক্ষর রেখেছেন দুজনে কন্যা বদল করে। ফলে ডেপুটি বাড়ি থেকে আমার মা ছদীদা খানম   আসলেন মুন্সেফ বাড়িতে। আমার একমাত্র ফুফু আম্মা জাহেদা বেগম আমার বড় মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কবির উদ্দিন আহমদ খানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলেন ডেপুটি বাড়িতে। আমরা ডেপুটি বাড়ি এবং মুন্সেফ বাড়ির ঐতিহ্যময় পরিবেশে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়েছি এবং সমৃদ্ধ হয়েছি।

ছোটবেলার তিনটি চারটি পাহাড়ে ডিঙ্গিয়ে  আমরা মায়ের সাথে পায়ে হেঁটে নানার বাড়ি যেতাম। মায়ের পিতামহ খান বাহাদুর নাসির উদ্দিন ছিলেন ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। নাসির উদ্দিন খানের খনিষ্ঠ  ছেলে আমার নানা তৈয়ব উল্লাহ খান কলিকাতা মাদ্রাসার ইংরেজি ব্রাঞ্চে ইন্টারমিডিয়েট আর্টে পড়াশোনা করেন। তার নিজস্ব লজিকের একটি পাঠ্য বই পাওয়া গেছে যা ইংরেজিতে রচিত। তিনি পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং জমিদার ছিলেন। তার নিয়ে নিয়মানুবর্তিতা  প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ট ছিলেন। নির্ভীক দক্ষ প্রশাসকের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার তাকে একটি ঘড়ি উপহার দেয়। স্পষ্টবাদী ও সত্যবাদী বলে তার নাম ছিল। তিনি কামলাদের সাথে ক্ষেতে খামারে নিজ হাতে কাজ করতেন। তিনি মূলক সোয়ানের প্রসিদ্ধ চৌধুরী বংশে বিবাহ  করেন। তার বিবির (আমার নানীর) নাম মোসলেমা খাতুন।

নানার ছয় ছেলে দুই মেয়ে। জৈষ্ঠ মেয়ের ছদীদা খানম আমার মা। স্বনামধন্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল তার পুত্র কামাল উদ্দিন খানের স্ত্রী।

এবার কিছু বলতে চায় তাদের সম্পর্কে যারা স্নেহ-মমতা ভালবাসা দিয়ে অশেষ ধৈর্য  সহকারে আমরা আট ভাই বোনকে  লালন করেছেন। সকলকে স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা হলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় প্রয়াত মা এবং আব্বা।এই প্রসঙ্গে তাদের আট সন্তানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া সঙ্গত মনে করছি ।

আমার সবচেয়ে বড় ভাই হাবিবুর রহমান বহু বছর চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৩ সালে করাচি চলে যান। সেখানে জেনারেল এন্ড ইকোনমিক রিসার্চ সেকশন প্রধান হিসেবে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের চাকরি করেন। তখন স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় যান এবং উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। মেজভাই লুৎফুর রহমান প্রথমে সে সময়ের জেমস ফিনলে  কোম্পানিতে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন । তিনি দরাজ গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং আমাদের গান শেখাতেন। সেজো ভাই আবু মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন সি.রিসোর্সেস লিমিটেড কোম্পানীর  রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর ছিলেন । তিনি অত্যন্ত পরোপকারী ছিলেন এবং বন্ধু বৎসল ছিলেন। সবচেয়ে ছোট ভাই আহমেদ ফরিদ বাংলাদেশ সরকারের সচিব পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীতে ইউ.এ.ই তে (সংযুক্ত আরব আমিরাত) রাষ্ট্রদূত হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বড় আপা হুসনুন নাহার এর  স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মোতাহের হোসেন চৌধুরী। চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক। মেজ আপা নুরুন নাহার এর বিয়ে হয়েছিল লোহাগাড়ার প্রফেসর বাড়িতে  অধ্যাপক আবদুল ওয়ালীর সঙ্গে। তারা দুজনেই বাল্যবিবাহের শিকার। এবার আমার পালা। ১৯৫২ সালের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি  একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী সাথে। তিনি "মাসিক সীমান্ত" পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আমি দীর্ঘ আঠারো বছর সমাজ কল্যাণ বিভাগের সরকারি চাকরি করেছি ।১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইউনিসেফ এ যোগদান করি। প্রথমে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রোগ্রাম প্লানিং সেকশনের প্রধান হিসেবে সাড়ে সতেরো বছর কাজ করেছি। এই দীর্ঘ কর্মযাত্রার অভিজ্ঞতা  এবং আমার জীবনের কিছু অমূল্য স্মৃতি বর্ণনা করে "স্মৃতিকথা: একটি অজানা মেয়ে" নামে একটি বই লিখেছি। সুপ্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ছোট বোন জাহান আরা ইসলাম (জুবলী) দীর্ঘ সময় ধরে বেতার এবং টেলিভিশনের সংগীত পরিবেশন করেছে।সংগীত শিক্ষক হিসেবে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলে বহু বছর কাজ করেছে। তার স্বামী নজরুল বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

আব্বা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে জলপাইগুড়ির বল্লাতে সাব রেজিস্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ছিলেন বিভাগপূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম জেলার প্রথম ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্টার। বিভিন্ন কর্মস্থলে তিনি সাধ্যমত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করার উদ্যোগ নেন। তিনি আধুনগরে এবং চকরিয়ায় দাতব্য চিকিৎসালয়  স্থাপন করেন।আব্বা ছিলেন একজন নিরব উন্নয়ন কর্মী ।অনেক দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ খরচে করেছে লেখাপড়া শিখিয়ে জীবনের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত প্রগতিশীল। আধুনিক ভাবধারাকে পছন্দ করতেন বলে তার সন্তানদের লেখাপড়ার পাশাপাশি গান বাজনা শেখার জন্যও উৎসাহিত করতেন। মনে পড়ে চুনতিতে বাড়ির উঠোনে আব্বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমাদেরকে গান শুনাতেন - "বাগে জাঁহামে আই বাহার" । পৃথিবীর বাগানে বসন্ত এসেছে। এতে অনুমেয় আব্বা কতখানি প্রকৃতি প্রেমিক এবং সাহিত্য রসিক ছিলেন। আবার  আনন্দ উপভোগ করাও যে মানুষের জীবনের অপরিহার্য উপাদান, এ ব্যাপারেও তিনি সজাগ ছিলেন । ছুটির দিনে আমাদের পিকনিকে কিংবা বেড়াতে নিয়ে যেতেন। শহরে ঘোড়ার গাড়ি করে সদরঘাট পুলে,  ট্যাক্সি করে পতঙ্গা সমুদ্র তীরে নিয়ে যেতেন। চুনতীতে  একবার আব্বার সাথে গিয়েছিলাম পাহাড়ে। হরিণ, পাখি, বুনোহাঁস শিকারে। আব্বা একজন স্নেহশীল পিতা ছিলেন। কিন্তু তার কঠোর শৃঙ্খলাবোধ কোনদিন বিসর্জন দিতে দেখিনি। সকালে এবং সন্ধ্যায় তার সন্তানরা সকলে পড়তে বসতে হবে। নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে। এর অন্যথা কিছু করা আমাদের সাধ্য ছিল না।

আব্বা রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজ শেষে ইংরেজি তরজুমা  সহ শুরু করে কোরআন শরীফ পড়তেন। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে তৎকালীন পপুলার সংবাদপত্র The Statesman পড়তেন ।স্নান সেরে মাথায় জবা কুসুম তেল দিতেন। গায়ে মাখতেন কিউটিকুরা পাউডার। তার ঘর ছড়িয়ে থাকতে এই দু'য়ের সংমিশ্রিত সৌরভ । তার স্মরণে আমি এখনও কিউটিকুরা পাউডার ব্যবহার করি আর তার স্মৃতির গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।

চুনতি  সমাজ ব্যবস্থায় প্রগতিশীল পরিবর্তন আনয়নে আব্বার অবদান অনস্বীকার্য। চুনতীকে আধুনিকায়নের পথে যাত্রা শুরু করার জন্য অগ্রগামীদের মধ্যে আব্বা অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছেন বলে আমার বিশ্বাস। একদিকে সাহেবদের মত আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদ পরতেন, অন্যদিকে চুনতী মাদ্রাসার একজন উদ্যোক্তা ও  ছিলেন। এক সময় তিনি হাকিমিয়া কামেল মাদ্রাসার জেনারেল সেক্রেটারি দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পরেও একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তাকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম শহরে চন্দনপুরাস্থা গুল-এ-জার বেগম বালিকা বিদ্যালয়ে অনারারী জেনারেল সেক্রেটারী হিসাবে কাজ করে এর প্রভূত উন্নতি সাধন করে গেছেন।


এবার মা'কে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ। মা নানা তৈয়বুল্লাহ খানের প্রথম কন্যা। মা বলতেন তার বাবা পাল্কীতে করে বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শনে  যাবার সময় তিনিও মাঝে মাঝে সঙ্গী হতেন। নানার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের গল্প শুনতেন। এতে মা'র মধ্যে গল্প পড়ার প্রবণতা জাগে। তাছাড়া মা'র ছোট ভাই কামাল উদ্দিন আহমদ খান কলকাতা থেকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পাঠাতেন। কামাল মামা লেখাপড়ার জন্য মা'কে দারুন ভাবে উৎসাহিত করতেন। বিশেষ করে এই সুবাদে মা সাহিত্যনুরাগী হয়ে উঠেন । তার কিছু লেখা তৎকালীন সওগাত, প্রভাতী ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছিল। মা আমাদের বাড়িতে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে একটি ছোট লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব ব্যাপারে আব্বা মা'কে সব সময় সহযোগিতা করতেন। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, কায়কোবাদ, বন্দেআলী মিঞা এবং সেই যুগের কবি সাহিত্যিকদের বইও  সেখানে সযত্নে  সাজানো থাকতো। ছোটবেলায় দেখেছি সংসারের কাজকর্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করে মা লাইব্রেরিতে বসে লেখাপড়া করতেন। তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু ভাষার উপর দক্ষতা ছিল অবিশ্বাস্য। আমাদের বাড়িতে গ্রামোফোনে নানা ধরনের গান বাজানো হতো। মা'কে এর সাথে গাইতেও দেখেছি। তিনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনায়াসে আবৃত্তি করতেন। এসব তার মুখস্থ ছিল। দুপুরবেলা ঠাকুর মার ঝুলি থেকে মা আমাদের রুপকথার গল্প পড়ে শোনাতেন। এত চমৎকার করে বুঝিয়ে দিতেন আমরা মুহূর্তের মাঝে কল্পনার জগতে চলে যেতাম। যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম রুপোর কাঠি সোনার কাঠি ছুইয়ে দেয়ার সাথে সাথে পাতাল পুরীর রাজকন্যা জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের মানস গড়ে ওঠে। মায়ের দীক্ষায় ভাই বোনদের সাংস্কৃতিমনা হওয়ার অপূর্ব সুযোগ পেয়েছি।

মা ছিলেন একজন মানবদরদী। তাকে ছোট-বড় ধনী দরিদ্রের মধ্যে কোন বৈষম্য করতে দেখিনি। তার নির্দেশে বাড়ির কাজের লোকদের আমরা কোনদিন নাম ধরে ডাকিনী। কাকে বুবু-দিদি কাউকে চাচা-কাকা, ভাই-দাদা এভাবে সম্বোধন করতাম। চুনতীতে আমাদের বাড়িতে দুধ, মুড়ি, ডিম ইত্যাদি বিক্রি করতে নিয়ে আসতেন দরিদ্র নারীরা। মনে পড়ে মা তাদের সযত্নে পিডিতে বসতে দিতেন। নাস্তা খাওয়াতেন। গল্প করতেন তাদের সাথে। বাড়ির কাজের লোকরা এবং এই শ্রেণীর লোকরাও মানুষ। তাদের সাথে আমরা যেন সম্মানের সহিত আচরণ করি এই শিক্ষা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে।

মা ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু ধর্মান্ধতা তার মধ্যে লক্ষ করিনি  কোনদিন। তাকে একজন মুক্ত মনের নারী বললে অযুক্তি হবে না। জীবনের এক পর্যায়ে মা আধ্যাত্মিকতার পাঠ গ্রহণ করেন। তিনি খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর বিশেষ শিষ্য ছিলেন(বর্তমানে আহসান উল্লাহ মিশন যার নামে খ্যাত)। শেষ বয়সে মা'র পঁচিশ বছর অন্ধত্ব জীবনে এই আধ্যাত্মিকতায় তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাতো । অন্ধত্ব বরণ করার পূর্বে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পৃক্ত করে একত্রিশ পৃষ্ঠার একটি বাংলা "মৌলুদ শরীফ" রচনা করেন। পরবর্তীতে এটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয় ।এই পুস্তিকা তার প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাধারা এবং সাহিত্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।

চুনতীর  কৃতি সন্তান আব্বা-মা আমাদের অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে পাড়ি দিলেন অসীমের পানে  এই সুন্দর পৃথিবীর বন্ধন চিরতরে ত্যাগ করে। আব্বা ৩১শে আগস্ট ১৯৬১ সালে এবং মা ৯ই জুন ১৯৯০ সালে। রেখে গেলেন তাদের কর্মের স্বাক্ষর। মনে পড়ে আমাদের চুনতীর  বাড়ির সাদা দেয়ালে আব্বা নিজ হাতে বড় বড় অক্ষরে কালো রঙ দিয়ে লিখে রেখেছিলেন ঃ

"এদিন চলিয়া যাবে ক্ষনকাল পরে,
রবে মাত্র কর্মফল চিরদিন তরে"

তথ্যসূত্রঃ

১)শকুর আলী মুন্সেফ পরিবার। ৬ প্রজন্মের আত্মোন্নয়ন প্রচেষ্টায় লেখ-চিত্র, আহমেদ ফরিদ  এপ্রিল ২০১৩

২)চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘরের কিউরেটর সামসুল হোসাইন সম্পাদিত ইতিহাস ও যাদুঘর সাময়িকী। জানুয়ারি -মার্চ ১৯৯৯

৩)ছিদ্দীকী বংশের একটি পারিবারিক ইতিহাস, ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান । ডিসেম্বর ১৯৯৮




Post Date : 21 Jun 2023
Share

Comments

Leave a Replay

Make sure you enter the(*)required information

Chunati.com~Posting Comments

Writers
  • আছমা উল্লাহ8
  • আছিম উল্লাহ নাবিল1
  • আজম মিনহাজ1
  • আদনান সাকিব21
  • আনোয়ারুল হক9
  • আবু উমর ফারূক আহমদ, পি এইচ ডি 5
  • আমিন আহমদ খান1
  • আহমদুল ইসলাম চৌধুরী16
  • উমেদ উল্লাহ খান12
  • এ ডি এম আব্দুল বাসেত (দুলাল)10
  • এম. তামজীদ হোসাইন29
  • এরশাদ উল্লা খান1
  • ওয়াহিদ আজাদ17
  • কশশাফুল হক শেহজাদ1
  • খাতুন রওনক আফযা (রুনা)57
  • চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য1
  • চুনতির ইতিহাস-সংগৃহিত3
  • ছাইফুল হুদা ছিদ্দিকী64
  • জওশন আরা রহমান2
  • ড. নাসের খান2
  • ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী2
  • ড. শব্বির আহমদ2
  • ডঃ মুঈনুদ্দীন আহমদ খান1
  • ডাঃ মাহমুদুর রহমান1
  • নায়েমা খানম শিমু1
  • প্রফেসর ড. আবু বকর রফীক2
  • প্রিন্সিপাল দীন মুহম্মদ মানিক12
  • ফরচুন শামীম5
  • মুহাম্মদ এশফাক হোছাইন1
  • মুহাম্মদ লুৎফুর রহমান তুষার5
  • মাইমুনা1
  • মাওলানা আজিজ আহমদ (আনু) 1
  • মাওলানা খালেদ জামিল2
  • মাসুদ খান5
  • মিজান উদ্দীন খান (বাবু)27
  • মিনহাজুন্নিছা 4
  • মোঃ নুরুল কিবরিয়া সাকিব (দিলকাশ চাটগামী)18
  • মোহাম্মদ আনোয়ার উল্লাহ (সুজাত)1
  • মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দিন1
  • মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন2
  • যাহেদুর রহমান1
  • রবিউল হাসান আশিক10
  • রুহু রু‌হেল4
  • রিদুওয়ানুল হক1
  • লায়লা মমতাজ রুপা3
  • শাহেদ হোছাইন2
  • সংগৃহীত21
  • সুজাত হোসেন1
  • সানজিদা রহমান নন্দন5
  • হাবিব খান22
  • হেলাল আলমগীর4

Categories
  • Article272
  • Poetry162

Important Link

  • Chunati At a Glance
  • Forum
  • Priyo Chunati
  • Condolences
  • Career Corner

Important Link

  • Educational Institutions
  • Clubs
  • Chunati High School Ex-Students Association
  • Terms of Use
  • Terms of Use~Priyo Chunati

Other Links

  • Founder
  • Admin Panel Members
  • Volunteer Panel Members
  • Social Works
  • Feedback

Contact Center

 Contact No: +8801313412646, +8801819383870,+6590252498(S'pore)
 Email: chunati.com@gmail.com

Copyright © 2006 www.chunati.com .All rights reserved.