হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহ রচিত মাকতুবাত শরীফে রাসুলুল্লাহ সা: এর হাদীসে বলা আছে, শেষ জমানার উম্মতে মুহাম্মদীর কিছু বুজুর্গ এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবেন যে, জান্নাতে যাদের মর্যাদা দেখে বনী ঈসরায়েলের নবীরা পর্যন্ত বিশ্ময় প্রকাশ করবেন। মাওলানা ফজলুল হক রহ ৭ টি ত্বরীকায় খেলাফত লাভ করেন হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী রহ থেকে এবং হযরত আজমগড়ী হুজুর রহ খেলাফত লাভ করেন ইমামুত ত্বরীকত হযরত সাইয়্যিদ আব্দুল বারী রহ থেকে। হযরত সাইয়্যিদ আব্দুল বারী রহ ছিলেন ত্বরীকতের মুজাদ্দিদ, তিনি হযরত ইমাম রাব্বানী রহ, হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী রহ, হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহ থেকে শুরু করে পুর্বেকার সকল ত্বরীকতের ইমাম থেকে রুহানিভাবে সরাসরি খেলাফত লাভ করেন। হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহ এর পরে আধ্যাত্মিক জগতে উনার মধ্যে দিয়ে সকল ত্বরীকা পরিপুর্ণতা লাভ করে। আর উনার ত্বরীকায় যে ৩ জন বুজুর্গ চরম উন্নতি সাধন করেন তারা হলেন হযরত হামেদ হাসান আলভী আজমগড়ী রহ, হযরত মাওলানা ফজলুল হক রহ এবং হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম আরকানী রহ। ৩ জনই জমানার কুতুব ছিলেন। গারাংগিয়ার ছোট হুজুর রহ নিজের লিখিত কসিদায় এই ৩ জনের কুতুব হওয়ার বিষয় উল্লেখ করেছেন। হযরত ইমাম রাব্বানী রহ মাকতুবাত শরীফে লিখেছেন প্রত্যেক জমানায় ৩ জন কুতুব বিদ্যামান থাকেন, তারাই সারা দুনিয়ার আউলিয়া, চল্লিশ আবদাল, ৭ গাউস, ৪ আওতাদগণের প্রধান, তারা ৩ জনই হলো পবিত্র কাবাঘরের রক্ষক। হযরত আজমগড়ী হুজুরের অন্যান্য খলিফাগণ সকলেই আধ্যাত্মিক জগতে উচ্চ মাকামের অধিকারী ছিলেন, বিশেষ করে হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ অজিহুল্লাহ রহ, হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ রহ, হযরত শাহ মাওলানা ফজলুর রহমান রহ, হযরত শাহ মাওলানা আব্দুল মজিদ রহ, হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ মুনীরুদ্দীন রহ তাদের মধ্যে অন্যতম। হযরত হাফেজ মুনিরুদ্দীন রহ প্রতিদিনের তাহাজ্জুদ সালাতে ১৫ পারা কুরান পড়তেন, তিনি বলেন উম্মতের এমন কোন ওলী আল্লাহ নাই যাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি, তিনি বলেন বিশেষ করে হযরত জুনাইদ বোগদাদি রহ আমার কাছে অধিকবার এসেছেন আর তারা সকলেই আমার নসব কোথা হতে এসেছে জানতে চাইতেন। হযরত আজমগড়ী হুজুরের বানী : ফজলে হক, হালিশহর জানা, অর মুনীরকো তালিম দেনা। হযরত মাওলানা ফজলুল হক রহ এই হাফেজ মুনীরুদ্দীনকে রহ তালিম দেওয়ার জন্য বহুবার হালীশহর গমন করেন। হালিশহর থেকে কিছু ত্বরীকার লোক একবার পাজেরো গাড়ী একটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিলো, বাড়িতে এসে নফল নামায আদায় করেছিলো, কিছুই খাননি, কারণ উনারা সবাই রোজা রেখেছিলো। তারা বলে গেছিলো, আমরা নিয়ত করে আমাদের পীরের পীরের বাড়ি দেখতে এসেছি, আমাদের পীর সাহেব হযরত হাফেজ মুনীরুদ্দীন রহ এর ইন্তেলের পড়ে হযরত আজমগড়ী হুজুর রহ মন্তব্য করেছিলেন, তোমরা আমার মুনীরকে নিয়ে কি ভাবছো, আমার জানা মতে তার মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার কাছে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহ থেকে কোনো অংশে কম না। মেহমানগণ বললেন, যদি আমাদের হুজুরের এতো অধিক মর্যাদা হয়, চুনতির বড় হুজুর আমাদের শায়খের শায়খের কতো উচ্চ মর্যাদা হবে! কুতুবদিয়ার মালেক শাহ রহ হযরত হাফেজ মুনীরুদ্দীন রহ এর মুরীদ ছিলেন, পরবর্তীতে মজ্জুব হয়ে গেছে হাফেজ মুনীরুদ্দীন রহ বলেছিলেন, তোমরা আমার আব্দুল মালেক এর সমালোচনা করিওনা, সে মজ্জুব হয়ে গেছে, তাকে তার মতো থাকতে দাও, তিনি তাকে অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। গারাংগিয়ার বড় হুজুর রহ পরবর্তীতে কুতুব হন। হুজুরের জীবনীগ্রন্থে জনাব আহমদুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন তিনি ত্বরীকতের অধিকাংশ সবক তাওয়াজ্জুহ মাওলানা ফজলুল হক রহ থেকে লাভ করেন। বায়তুশ শরফের সাবেক সেক্রেটারী জনাব আমান উল্লাহ খান বলেন মাওলানা ফজলুল হক রহ একবার আসরের নামাযের পরে গারাংগিয়ার বড় ও ছোট হুজুরদ্বয়কে এমন ক্ষিপ্রগতিতে তাওয়াজ্জুহ দান করেন যে, যার ফলশ্রুতিতে দুই ভাই থরথর করে কাপছিলেন, এমন অবস্থা দেখে সেখানকার লোকেরা ভয় পেয়ে যায়, লোকেরা দেখতে পান হুজুরেরা এক ভাই বদনা দিয়ে পানি ঢালতেছিলো আরের ভাই নিজের হাত দিয়ে মাওলানা ফজলুল হকের রহ পা ডলে ডলে পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন। আহমদুল ইসলাম চৌধুরী সেই গ্রন্থে আরো লিখেছেন চুনতির শাহ সাহেব হুজুর রহ যখন নবীজীর সা: রওজামুবারক জিয়ারত করছিলেন তখন হুজুর সা: এর সাথে রুহানি সাক্ষাত হয়, হুজুর সা: বললেন তুমি যখন বাড়িতে চলে যাবে আমার আব্দুল মজিদকে আমার একটা সালাম দিও, যদিও তার সাথে আমার প্রতি সপ্তাহে তোমার মতো এভাবে সাক্ষাত হয়। তিনি গ্রন্থটিতে আরো লিখেছেন, একবার কদরের রাতে চুনতির সাহ সাহেব হুজুর রহ কদরের রাত পান, তিনি আধ্যাত্মিক উরুজ (আধ্যাত্মিক ভাবে উপরের দিকে ভ্রমণ) করতে থাকেন, যাইতে যাইতে উনার ক্বলবে যতো শক্তি ছিলো গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, আর উপরের দিকে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো না, তিনি আরো অনেক উপরের মাকামে মাওলানা আব্দুল মজিদকে রহ দেখতে পান, তখন তিনি তার হাত দিয়ে বড় হুজুরকে রহ ধরতে চেষ্টা করেন ( এটা আধ্যাত্মিক হাত, যেমন আবুল হাসান খেরকানী রহ মন্তব্য করেছিলেন মাঝেমধ্যে আল্লাহ আমাকে এমন আধ্যাত্মিক শক্তি দান করেন যে, আমার মনে হয় আমি হাত দিয়ে আসমান নিচে নামিয়ে আনতে পারবো), তারপর একটা বাশ দিয়ে চেষ্টা করেন, তারপর সেই বাশের সাথে আরেকটি বাশ জোড়া লাগিয়ে চেষ্টা করেও বড় হুজুরের নাগাল পান নি, তারপর তিনি আল্লাহ যেনো বড় হুজুরকে আরো উপরে নিয়ে যান এই দোয়া করেন, বড় হুজুরের পা টিপে দিতে দিতে চুনতির সাহ সাহেব হুজুর এমন কথা বলছিলেন। জনাব আমান উল্লাহ খান বলেন, আমরা একবার বড় হুজুরকে বাড়িতে দাওয়াত দিই, যখনই কেউ একজন হুজুরকে আমার আম্মা মাওলানা ফজলুল হকের রহ ভাগনী পরিচয় দেন, হুজুর একদম বোবা হয়ে দাড়ানো অবস্থা থেকে বসে যান, অঝোর নয়নে কান্না করতে করতে বলেন, তোমরা যে নামটা উচ্চারণ করেছ, তা আমি সইতে পারছিনা, উনি না থাকলে আমি আব্দুল মজিদ কিছুই পেতাম না! মাওলানা ফজলুল হক রহ এর বহু কারামাত রয়েছে, অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে লেখা তাই লিখা সম্ভব না। তবে যে কারামাতের কথা মরহুম আবু জাফর ছিদ্দিক প্রায় সময় বলতেন, হযরত ওয়ায়েস করণী রহ রুহানীভাবে উনার সাথে সাক্ষাত করে বলেন, ফজলে হক, তুমিতো সবার ত্বরীকাই চালাচ্ছ, আজ থেকে আমার ত্বরীকাতেও তোমাকে খেলাফত দিলাম। মরহুম জাফর ছিদ্দিক সাহেব প্রায়ই বলতেন একদিন হযরত ওমর ফারুখ রা: রুহানীভাবে এসে উনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ফজলে হক তুমি আমার বংশের গৌরব। মাওলানা ফজলুল হক রহ হিজবুল বাহারের জাকাত দিতে হালিশহর অবস্থান করেছিলেন, এভাবে সাগরে অবস্থিত সকল জিন উনার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলো। মসনবী শরীফে এসেছে, সবচেয়ে উচ্চ শ্রেণীর বুজুর্গগণ সোনা প্রস্তুত করতে সক্ষম, আর মাওলানা ফজলুল হক রহ ও মাওলানা হাফেজ অজিহুল্লাহ রহ মিলে সোনা ততৈরি করেছিলেন। চুনতির সাহ সাহেব হুজুর মজ্জুব অবস্থায় এর জন্য এই দুজন খলিফাকে গালি দিতেন (অবশ্য তিনি মজ্জুব অবস্থায় হযরত ওমরকেও গালি দিয়েছিলেন, কারণ ওমর রা: খোলা তরবারি হাতে নিয়ে নবীকে সা: আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন)। এটা মুহাব্বতের গালি কিন্ত অনেকে এটার হাকিকত বুঝেনা, এই গালিতে উনাদের মান সম্মান কখনো কমে যায় না।
মরহুম ওবাইদুর রহমান রহ নিজের পীর সাহেবের বরাত দিয়ে বলেন, আমরা বিভিন্ন বুজুর্গদের সম্পর্কে আমাদের হুজুরকে জিজ্ঞাসা করতাম, কিন্ত যখনই মাওলানা ফজলুল হক রহ ও মাওলানা হাফেজ অজিহুল্লাহ রহ এর নাম বলতাম, আমাদের হুজুর রহ নিজ হাতে নিজের সিনায় বারি দিয়ে বলতেন, ওম্মারম্মা ইতারা দুনুয়াই বহুত বড় বুজুর্গ। পীরানে পীর হযরত হামেদ হাসান আলভী আজমগড়ী রহ হুজুর নিজের খলিফা হওয়া সত্তেও কোনোদিন মাওলানা ফজলুল হককে রহ নাম ধরে ডাকেন নি ( মাওলানা ফজলুল হক রহ বয়সে উনার পীর সাহেব হুজুরের ১০ বছরের বড় ছিলেন)। একবার চুনতি জামে মসজিদের পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছিলো, আজমগড়ী রহ হুজুরের রুই মাছ খুব পছন্দ ছিলো, লোকেরা হযরত আজমগড়ী হুজুরকে রহ ছাতা ধরলে উনি বললেন, আমি গরমের দেশের মানুষ, গরম সহ্য করতে পারি, তাই তিনি তার খলিফা মাওলানা ফজলুল হকের রহ মাথার উপরে ছাতা ধরার নির্দেশ দান করেন। লোকেরা যখন হুজুরের জন্য একটা চেয়ার নিয়ে আসলো, তিনি যতক্ষণ আরেকটা চেয়ার নিয়ে আসা হয়নি, ততক্ষণ বসলেন না, আরেকটা চেয়ার আনার পরে দুজন একসাথে বসলেন। নিশ্চয় এটা মাওলানা ফজলুল হকের রহ অনেক উচ্চ মর্যাদার ইংগিত বহন করে। হযরত বাকী বিল্লাহও রহ উনার খলিফা হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানীকে রহ অনুরূপ সম্মান প্রদর্শন করতেন। আরও অনেক লিখার ইচ্ছা ছিলো, পরিশেষে বলছি আজকাল সব জায়গায় শুধু জয়বাংলার ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই লিখা হয়না। আল্লাহ বলেন, হে নবী, আপনি প্রচার করুন, বাহকের দায়িত্ব কেবল পৌছাইয়া দেওয়া। তাই চুনতির এই নক্ষত্রের কথা কিছু লিখলাম, যার বংশধরদের মধ্যে অনেক সামর্থ্যবান লোক আছে, পুলিশের এ আই জি আছে, ইন্ডাস্ট্রির মালিক আছে, বড় বড় পয়সাওয়ালা আছে, কিন্ত টাকার অভাবে তার একটা জীবনীগ্রন্থ ছাপানো গেলো না, আমরা কিছু আছি টাকা পয়সা নাই, কলমের সামান্য শক্তি আছে বলে বকবক করি। কবিতার ভাষায় বলি- কুসুম ফুটিয়াছিলো কাননে, তার সুরভি ছড়ায়েছিলো সমীরণে, সেই কুসুমের নাম শাহ ফজলে হক রহ, তাহা চুনতিতে ফুটিয়াছিলো আবার চুনতিতেই ঝরিয়াছিলো, তবে তাহার সুবাস মান, সৌন্দর্য তাহার চির অম্লান।
Make sure you enter the(*)required information