পানের ইংরেজি প্রতিশব্দ Betel. এর বৈজ্ঞানিক নাম Piper betel. এটি সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের পিপুল প্রজাতির গুল্মজাতীয় গাছের পাতা। মিঠা পাতি, মালবী, মাদ্রাসি, বেনারসী, কর্পুরী প্রভৃতি প্রজাতির পান রয়েছে। একেক প্রজাতির পানে রয়েছে একেক ধরনের স্বাদ। তবে অধিকাংশ মানুষ-ই মিষ্টি পান খেতে পছন্দ করেন। পানে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোফিল থাকে। তাই পানের রস শরীরে ঔষধি হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে বয়স্করা চা, জলপান, ভাত খাওয়ার পর মুখ সতেজ রাখতে পান খেয়ে থাকেন। সাথে চুন(পান খাওয়ার চুন), সুপারি, জর্দাও থাকে। বয়স্করা পানের সাথে খুব আনন্দের সাথে চুন, সুপারি, জর্দা মিশিয়ে খেয়ে থাকেন। তবে বয়স্কদের দেখে কমবয়সীরা কেউ পান খেতে চাইলে তখন বয়স্করা চুন খেতে বারণ করেন। সুপারি প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। কাঁচা সুপারি, পাকা সুপারি। অনেকেই নিশ্বাস সুরভিত রাখতে, ঠোঁট, জিহ্বা লাল করতে পানের সাথে চুন খেয়ে থাকেন। প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীরা পান খেতে অভ্যস্ত। পান ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই বেশ প্রচলন রয়েছে। বিবাহ অনুষ্ঠানে, শিশুদের আকিকা অনুষ্ঠানে, বৌভাত, পান ছল্যা, পূজা, পুণ্যাহ নানান ধরণের শুভ কাজে বা অনুষ্ঠানে গুরুজন ও মুরব্বীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য পানের ব্যবহার দেখা যায়। অনেক সময় অনুষ্ঠান শেষের দিকে পান পরিবেশন করে প্রস্থানের সময় ইঙ্গিত করা হয়। একসময় সুন্দরভাবে পানদানিতে পান সাজিয়ে রাখলে মানুষ ধারণা করতেন এটি নিশ্চয়ই অভিজাত পরিবার। এই ধরণের পরিবারের সাথে মানুষ বিয়েশাদির মাধ্যমে নতুন আত্মীয়তা করার জন্য আগ্রহ দেখাতেন।
বিশেষ করে চট্টগ্রামের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত লোহাগাড়া উপজেলায়ও ঐতিহ্যগতভাবে পানের প্রচলন রয়েছে। উপজেলার চুনতি, বড়হাতিয়া, আধুনগর, পদুয়াসহ আরো কয়েকটি ইউনিয়নে পানের চাষ করা হয়। তবে উপজেলার চুনতি এলাকায় বেশি পান চাষ হয়। এই এলাকার সাতগড়সহ পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পান চাষ হয়ে থাকে। চুনতি ইউনিয়নের সাতগড় এলাকায় রাস্তার পাশে কৃষি জমিতে, টিলায় ও পাহাড়ের নিচে সমতল জমিতে প্রচুর পান চাষ করা হয়। অন্যান্য গাছের চেয়ে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে পান চাষ করা লাগে। এই বিশেষ আঙ্গিকের পান চাষের জমিকে বলা হয়ে থাকে পানের বরজ। প্রত্যেক বরজে সারি সারি পানের লতা ভর্তি পানের ফলন হয়ে থাকে। বরজে প্রতিটি পান গাছের জন্য খুঁটি ব্যবহার করা হয়। যেসব খুঁটিতে পেঁচানো পানের লতায় ধরে প্রচুর পান। এই উপজেলার পানগুলো বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। তবে আকারে ছোট হলেও মিষ্টি পানের বেশ চাহিদা রয়েছে।বহু আগে থেকেই পান ঐতিহ্যগতভাবে লোহাগাড়ার মুরব্বিদের কাছে প্রসিদ্ধ একটি খাদ্যদ্রব্য হিসেবে প্রচলন রয়েছে। পানের সাথে যেহেতু সুপারি, তামাক পাতা, চুনের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাই এসব দ্রব্য এই এলাকায় খুবই সহজলভ্য। উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে এসবের চাষ হয়ে থাকে। অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে চুন উৎপাদন করে থাকেন। চুন উৎপাদনে ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীরা ঝিনুক, শামুক ব্যবহার করে থাকেন। কিছু কিছু এলাকায় পরিবার-ভিত্তিক চুনের উৎপাদন হয়ে থাকে। অনেক পরিবারে বংশপরম্পরায়ও এই ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। শামুক, ঝিনুকের খোলস পুড়িয়ে প্রাথমিকভাবে চুন উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে সুপারি, তামাকের চাষ হয়ে থাকে। বিশেষ করে নদীর ধারে বা পুকুর পাড়ে এসব গাছ লাগানো হয়ে থাকে। এছাড়াও বাড়ির উঠোনের সীমানা প্রাচীর হিসেবে মানুষ সারিবদ্ধভাবে সুপারির গাছ লাগাতেন। এখন হয়তো আধুনিকতার যুগে মানুষ ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়েই সীমানা প্রাচীর দিয়ে থাকে। এখনো উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সুপারি গাছ রয়েছে। লোহাগাড়ার ব্যবসায়ের প্রাণকেন্দ্র বটতলী স্টেশনে অনেক বিশাল পান-সুপারির আড়ৎ রয়েছে। যেসব আড়ৎ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাজারজাত করে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লোহাগাড়ার ব্যবসার চাকা সচল রেখেছেন। তাছাড়া ইউনিয়নের হাটবাজারে মানুষ হাটের দিন পান, সুপারি, চুন এসব বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন এই দৃশ্য অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।এলাকার কেউ পাত্রী দেখতে গেলে নতুন অতিথি হিসেবে মিষ্টি এবং ফলের সাথে পান, সুপারি, চুন এসব বাধ্যতামূলক নিয়ে যান। পান না নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলে অনেক মুরব্বীরা আবার এটাকে অসম্মানজনক কাজ বলে মনে করেন। পান সুপারি ছাড়া বেড়াতে গেলে তাদের সাথে নতুন আত্মীয়তা করাকে অনেকেই এই সম্পর্কে অমঙ্গল হবে এমনটা ধারণা করেন। এখানে মুসলিম পরিবারে গাঁয়ে হলুদের আগের রাতে "পান ছল্যা(পরামর্শ)" নামে একটি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। মূলত বিবাহের পূর্ব প্রস্তুতির জন্য বর-কনে উভয় পক্ষের বাড়িতে অভ্যন্তরীণ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যদিও এটি গ্রামে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তথাপি উপজেলার চুনতি, বড়হাতিয়াসহ অন্যান্য ইউনিয়নের কিছুকিছু গ্রামে বা মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারে এটি প্রচলিত আছে। এই অনুষ্ঠানে এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তিদেরকে আমন্ত্রণ করা হয়। সবাই একসাথে বসে আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ করে থাকে। পান ছল্যায় প্লেট ভর্তি পান, সুপারি, চুন, বিভিন্ন জর্দাও সাজিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সাথে চা, বিস্কুট তো থাকেই। বিয়ের দিন বর-কনে উভয় পক্ষের মধ্যে মা, চাচী, দাদী, নানী, ফুফু, মামীরা আপ্যায়ন করার জন্য পানকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মুরব্বীরা কোথাও বেড়াতে গেলে সাথে করে পান নিয়ে যান। পানের অভ্যাস তাদের কাছে নেশার দ্রব্যের মত। পান না খেলে তাদের মনে হয় যেন কিছুই খাওয়া হয়নি। যদি ভুলবশত পান না নিয়ে যান তাহলে তড়িঘড়ি করে আত্মীয়ের বাড়িতে পানের বাড়া(পানদানি) খুঁজেন। বয়স্করা কেউ কারো সাথে কেউ মান অভিমান বা রাগ করলে পান খাওয়াইয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেন। কালের বিবর্তনে পানের চাহিদাসম্পন্ন রুচিশীল মানুষদের পান খাওয়ার শৈলীগত দিক থেকে পরিবর্তন এসেছে। ইদানীং পানের সাথে সুপারি, চুন, জর্দা, তামাক পাতা ছাড়াও আরো অনেক দ্রব্য মিশ্রণ করে পান খাওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে মফস্বল শহরে বা নগরে কিছু কিছু দোকানে স্পেশাল পান বিক্রি করা হয়। এসব পানে ব্যবহার করা হয় হরেক রকমের মশলা। যেমনঃ নারকেল, জিরা, আদা ইত্যাদি। চট্টগ্রাম শহরে ক্যাপ্টেন নামে এক ধরণের পান বিক্রি হয়। শহরের তরুণেরা এটি খেতে বিষণ পছন্দ করেন। কালে কালে কত কিছুই তো পরিবর্তন হয়েছে। তবে এলাকার মুরব্বিরা সেই আদিম তরিকায় পান খেয়ে থাকেন। তারা তাদের ঐতিহ্যকে এখনো খুব সুচারুভাবে ধরে রেখেছেন।চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী প্রয়াত শেফালি ঘোষের গানেও বাঙালির পানের ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তার এই গানের মধ্যদিয়ে বুঝা যায় চট্টগ্রামে পানের কতটা প্রচলন ছিল। তাঁর বিখ্যাত গানটিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এখনো সেই গানের প্রচলন আছে।"যদি নতুন একখান মুখ পাইতামমইশখালীর পানের খিলি তারেবানাই খাবাইতাম ।"
Make sure you enter the(*)required information