চৈনিক সভ্যতা সুপ্রাচীন। প্রাচ্যের রহস্যময় রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে অন্যান্যদের মতো গড়পড়তা পরিচয়ে প্রচারণা না পেলেও, এর রহস্যময় সমাজ ব্যবস্থা আধুনিককালে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরপর পরিচিতি পায়। উল্লেখ্য, চীনে দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য, প্রথা ও সংস্কৃতির সাথে একিভূত হয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ সমভাবে বিকশিত হয়েছে। ১৪, ১৫ ও ১৬ শ শতকের "মিং" আমলে চীন পাশ্চাত্যের সাথে মেশার চেষ্টা করে, আধুনিক শিল্প বিপ্লবের সাথে পরিচিত হয়, শিক্ষা সংস্কৃতিতে fusion, diversity আনার চেষ্টা করে। উল্লেখ্য, এই সময়ে চীনের ঐতিহ্যবাহী "পোরসেলিন" শিল্প প্রসার লাভ করে। ঐতিহাসিক চীনের শাসন ব্যবস্থা অনেকটা আঞ্চলিক ও সামন্তশাসিত ছিল, যদিও কেন্দ্রীয় রাজ শাসন এগুলোকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থায় আনার চেষ্টা করেছে। এ ধারাবাহিকতায় ২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে "কিন শি উয়ান" প্রথম সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। যুগে যুগে এখানে রাজা-সম্রাটদের শাসন ছিল, যাদের ছাপ চীনের বিভিন্ন অবকাঠামো ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি 'গ্রেট ওয়াল’ স্থাপত্যে ফুটে উঠে। 'গ্রেট ওয়াল' নিয়ে বিভ্রান্তি প্রচলিত আছে। আমরা অনেকেই মনে করি 'গ্রেট ওয়াল' একটি একক স্থাপত্য। না, বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় রাজাগন নিজেদের বহি:শক্রর (যাযাবর গোষ্ঠী, মূলত হিংস্র মোংগল গোষ্ঠী) আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে নিজ রাজ্য পরিমন্ডলে খন্ড খন্ডভাবে এগুলো নির্মাণ করেন (আনুমানিক সংখ্যা কয়েক'শো) কিন শি, হান, শাং, গোগুরিও ও মিং এর আমলে অনেকটা কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামূলক কৌশলের অংশ হিসেবে দীর্ঘ অংশগুলো নির্মাণের পাশাপাশি খন্ড অংশগুলোকে জোড়া লাগানোর প্রচেষ্টা গৃহীত হয়। এসময় রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার বাইরে সুরক্ষিত নগরায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের (ঐতিহাসিক সিল্ক রোড) নিরাপত্তার দিকটাও বিবেচিত হয়। চাঁদ হতে এটিই একমাত্র দৃশ্যমান মানবসৃষ্ট অবকাঠামো দাবী করা হলেও এ বিষয়ে সংশয় আছে। চীন ৫৬ টি নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত ও লোকসংখ্যা ১৫০ কোটিরও বেশি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনের জনগোষ্ঠীর ৯২% "হান নৃগোষ্ঠী" ও ৮% অন্যান্য ৫৫টি নৃগোষ্ঠী। প্রাচীন চীন নিজের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যুদ্ধের কারণে ইতিহাসবিদদের কাছে বহুল পরিচিত। কিং ও মিং রাজবংশের যুদ্ধ, তাইপেং বিদ্রোহ, আন লুসান বিদ্রোহ, ডানগেন বিদ্রোহ ও চাইনিজ সিভিল ওয়ার বহুল আলোচিত। অবশ্য চীনের এ সমস্ত যুদ্ধবিগ্রহ সামরিক কৌশলের উন্নতি ঘটিয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণের অভিমত। যেমনঃ রকেট, ক্রস বো, মিনজানিক কামান (ক্যাটাপল্ট নির্ভর নিক্ষেপক), আতশবাজি ইত্যাদি প্রযুক্তির উদ্ভাবন। খৃষ্টপূর্ব ৬'শ শতকে শা'ন ঝু (Sun Tzu), যিনি একাধারে জেনারেল ও দার্শনিক/লেখক ছিলেন। তিনি strategic dogma 'সামরিক আক্রমন না চালিয়ে বিনা রক্তপাতে রাজ্য দখল পরিকল্পনাই শ্রেষ্ঠতর যুদ্ধকৌশল' এর প্রবর্তক, যা বর্তমান যুগের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসনের নামান্তর বলে আলোচিত ও সমালোচিত। চৈনিক শিল্প সম্ভার চীনের স্বর্নালী অতীতের এক অনুপম স্বাক্ষী। তবে এরও ইতিহাস আছে। রাজা/সামন্ত শাসকদের কঠোর রাষ্ট্রনীতির ফলশ্রুতিতে একসময় 'ইম্পেরিয়াল চীন' আমদানি বাণিজ্য সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়। এ প্রেক্ষিতে উদ্ভুত বৈরী শাসন ব্যবস্থার মুখে টিকে থাকার লক্ষ্যে চীনে কুটির শিল্পের প্রসার ঘটে। এক পর্যায়ে দেশটির শিল্প পণ্য তৈরির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা আমদানিকৃত পণ্যের অনুকরণে নিজস্ব প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে (copycat) নতুন একটি পণ্যের উদ্ভাবন করে, যা পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত 'মেড ইন চায়না' ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পায়। অবশ্য অর্থনৈতিক এরূপ উঠতি পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজা ও স্থানীয় সামন্তবাদীদের কঠোর শাসন ব্যবস্থা অনেক চীনাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। জীবিকার তাগিদে তারা ইউরোপ, আমেরিকা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য দেশত্যাগি চীনারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে 'China Town' গড়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে প্রাচ্যের খাবার (Chinese Food), চিকিৎসা পদ্ধতি (বিশেষত ভেষজ ও আকুপাংচার) ও সংস্কৃতি (Meditation, Kung Fu Martial Art, Shaolin Myth) বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে । চীনের এই ধারাবাহিক উত্থান সহজ ছিল না। কথিত আছে, ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়রা চায়নিজদের ''আফিম'' খাইয়ে প্রায় ২০০ বছর ঘুমিয়ে রেখেছিল। মুলত ব্রিটিশ ও সহযোগী অপর কয়েকটি দেশ চীনে মাদকের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে তরুণ/যুবকদের মাদকাসক্তিতে নিমজ্জিত করিয়ে দেশটিকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। তবে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ ও তাদের সহযোগী গোষ্ঠীসমুহ মাদক ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্ত অর্জন করে। 'প্রথম অপিয়াম যুদ্ধে' (১৮৫০ সালের ০২ বছর আগে-পরে) কিং (Qing) রাজা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আফিম ব্যবসার বিরুদ্ধাচারণ করেন কিন্তু তিনি ১ম মহাযুদ্ধের পরাজিত জার্মানির মত কঠোর পরিনতি ভোগ করেন ( উল্লেখ্য ভার্সেই চুক্তির কঠিন শর্তাবলির মাধ্যমে জার্মানিকে দুর্বল করে দেয়া হয়), অর্থাৎ সাময়িকভাবে পরিস্থিতি চীন জাতির প্রতিকুল হয়ে উঠে। এর ফলে চীনা সাম্রাজ্য বাণিজ্যে ব্যাপক ছাড় দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ১৮৬০ ও আগে-পরের আনুমানিক ০৪ বছর ব্যাপী চীন পুনরায় মাদক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন, এবার প্রতিপক্ষ ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এবারেও চীন পরাজিত হয় ও ইউরোপীয়দের আরো সহজ শর্তে বাণিজ্যের অনুমতি দিতে বাধ্য হয় (দু'দুটি যুদ্ধে হাজার হাজার ইউরোপীয় ও চীনা সৈন্যের মৃত্যু ঘটে)। এ সময় চীন হংকং এর উপর সার্বভৌমত্ব হারায়। চীনকে বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে ১৮৯৮ সালে ১০০ বছরের জন্য হংকং কে ব্রিটিশদের নিকট লিখে দিতে হয়। তবে, একটি বিষয় ঠিক অপিয়াম যুদ্ধের মাধ্যমে চীন তার নাগরিকদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিল। যাইহোক চীনা সাম্রাজ্য আবার অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাইপেং বিপ্লব ও ডানগেন বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। বিপর্যয়কর এই গৃহযুদ্ধে কয়েক কোটি নাগরিকের মৃত্যু হয়। ডানগেন বিদ্রোহের (১৮৬০/৬৫) মাধ্যমে চীনা সাম্রাজ্য প্রথমবারের মতো চীনা মুসলিম সম্প্রদায়ের (Hui নৃগোষ্ঠী, যা চীনের বৃহৎ মুসলিম গোষ্ঠী। এরপর রয়েছে 'উইঘুর' গোষ্ঠী) সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ইয়েলো রিভারের তীরে সংঘটিত এমন একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় ২/৩ কোটি চীনা নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। এরপর চীন জাতীয়তাবাদী কুমিংটান শাসনকালে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে প্রতিবেশী রাশিয়ায় দেশটির সমাজতান্ত্রিক 'ছোট দল' অর্থাৎ বলশেভিক অপ্রত্যাশিতভাবে জাতীয়তাবাদী 'বড় দল' অর্থাৎ মেনশেভিককে পরাস্ত করে, যা চীনের রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। মাও সে তুং নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দল ১৯২৭ সালে চীনের জাতীয়তাবাদী প্রজাতন্ত্র সরকারের সাথে 'Civil War' এ লিপ্ত হয় ও ১৯৪৯ সালে ''চিয়াং কাই শেক'' নেতৃত্বাধীন কুমিংটানকে (Republic of China) বর্তমান তাইওয়ানে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে ও People's Republic of China প্রতিষ্ঠা করে। ''দেং জিয়াওপি'' এর শাসনকাল চীনকে সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ সংমিশ্রিত অর্থনীতির ধারণা দেন। ''কমিউন'' ব্যবস্থা প্রবর্তনের সাথে তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন। এ সময়ের একটি গল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তা পায়। একবার ''দেং'' কে পাশ্চাত্যের জনৈক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ''আপনি সাইকেল চলাচলের জন্য এত বড় রাস্তা তৈরি করেছেন কেন?'' উত্তরে দেং বলেছিলেন, ''একসময় এত বড় বড় রাস্তা চীনের যানবাহনের জন্য অপ্রতুল হয়ে পড়বে''। বাস্তবে তাই হয়েছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৮৯ সালে ''তিয়ানামেন স্কোয়ারে' গণত্রন্ত্রকামীদের হত্যার দায় রয়েছে। তাঁর উত্তরসূরী ' লী পেং' ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করত: সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ''মিশ্র অর্থনীতি'' নিয়ে দেং এর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেন। এটি 'মিশ্র অর্থনীতি'র অভিনব হাইপোথেসিস কে বাস্তবায়িত করে ও চীনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় এবং চীন আপাতত সফল হয় বলে প্রতীয়মান। সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হওয়া চীন কুটির/ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হতে বৃহৎ শিল্পের দিকে ধাবিত হয়, বিশ্বের বড় বড় পুঁজিপতিদের আকৃষ্ট করে। তবে 'অনুকরণ, (Copycat) বিদ্যাকে চীন ত্যাগ করতে পারেনি। বরং 'Reverse Engineering & Technology' এর সার্থক জনক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে চীনকে কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হয়, গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। চীন উন্মুক্ত পুঁজি গ্রহণ করলেও বিনিয়োগে সরকারকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হয়েছে। চীন উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে ব্যাপক নিয়ম-নীতি কঠোরভাবে গোপনীয়তার সাথে অনুসরণ করতে থাকে। ''কমিউন'' প্রথার মাধ্যমে সম্পদের জাতীয়করণ ঘটে। এখানে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র ধনী, তবে রাষ্ট্র তার নাগরিকের স্বচ্ছলতা, শিক্ষা, আবাসন, চিকিৎসাজনিত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। বর্তমান বিশ্বের ধনী গ্রামটি চীনে অবস্থিত (যদিও লোকেরা ধনী, তবে সম্পদ হস্তান্তরিত হতে পারবে না, নিজ ইচ্ছায় যেখানে সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারবে না; অর্থাৎ রাষ্ট্রই তার নিয়ন্ত্রক)। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের বিশাল প্রভাব রয়েছে (২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি)। চীন অর্থনীতি দিয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চায়। কিছু কিছু সূত্র দাবি করে ২০৫০ সাল নাগাদ চীন একটি বড়সড়ো অর্থনীতি তৈরীর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এরমধ্যে সে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জড়িয়ে অহেতুক সম্পদ অথবা সময় বিনষ্টের পক্ষপাতী নয়, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা ও ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক অনেকটা যুদ্ধংদেহি মনোভাবাপন্ন। অবশ্য এসব কারণে উক্ত দেশসমূহের সাথে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে তা নয় বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা আরও জোরদার হয়েছে। চীনারা খুবই বাস্তববাদী এবং তারা আবেগকে প্রশ্রয় দেয় না। চীন একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা একযোগে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সে কারণে বেশ কয়েক বছর চীনাদের ১ বা ২ সন্তান নিয়ে থাকতে হয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতে চীনের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। কারণ যুবক বা তরুন প্রজন্মের সংখ্যা কমে যাওয়ায় চীন ভবিষ্যতে উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠী পাবে না এবং বিপরীতভাবে বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে যাবে, যা তার ভিশন ২০৫০ কে বাঁধাগ্রস্ত করবে। এমতাবস্থায় চীন সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পলিসিতে পরিবর্তন এনেছে। চীন সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছে। চীনা শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তাই এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ভোকেশনাল ও ডিপ্লোমা শিক্ষা নির্ভর। মাস্টার্স সম্পন্ন চীনা নাগরিকের সংখ্যা খুবই কম। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা ''জব অরিয়েন্টেড''। পেশাগত কারণে যে পদ্ধতিতে একজন কর্মজীবীর যে পরিমাণ ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন, তাই নাগরিকদেরকে শেখানো হয়। যেমন, আমরা ফাউন্ডেশন লেভেলের শিক্ষার্থীদের গ্রামার এর মাধ্যমে ভাষা জ্ঞান শেখাই। ঐখানে তা না, প্রয়োজনীয় অক্ষর/শব্দ জ্ঞান শেখানোর উপর জোর আরোপ করা হয়, অনর্থক সময় ক্ষেপণ করাকে তাঁরা সমর্থন করে না। চাইনিজ শিশুদের গতানুগতিক স্কুল শুরুর পূর্বে ২/৩ বৎসর শুধু পারিবারিক ও সামাজিক Custom's & Etiquette শেখানোর পেছনে ব্যয় করা হয়। কলেজ লেভেল এর শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের এক পর্যায়ে সারভাইবেল ট্রেনিং কোর্স করানো হয়। এই কোর্স অনুসরণে, শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, যেন তারা বিদেশের অচেনা কোন জায়গায় এসেছে। যতটুকু সম্ভব তারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলে এবং কোর্স চলাকালে আর্থিক সাহায্য বা কাজের সহযোগিতা চেয়ে থাকে, উন্নত জাতের ''ভিক্ষাবৃত্তির'' মতই। তবে তাদের অর্জিত ভিক্ষা কোন না কোনভাবে স্থানীয় দরিদ্র শ্রমিক কিংবা গরিব পরিবারকে দান করে দিতে বলা হয়। যেহেতু চীনের সমাজে দরিদ্র শ্রমিক কিংবা পরিবার অহেতুক সাহায্য নিতে চায় না, তাই অর্জিত অর্থ স্কুল কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেয়ার নিয়ম আছে।চীনে ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন রয়েছে। কাগজের মুদ্রার ব্যবহার প্রায় উঠে যাচ্ছে। তারা স্মার্টফোনের সামাজিক ওয়েবসাইট ''উইচ্যাট'' ব্যবহার করে, যা ফেসবুক এর বিকল্প (চীনে ফেসবুক ব্যবহার নিষিদ্ধ)। এই অ্যাপস এর মাধ্যমে যাবতীয় লেনদেন, কেনাকাটা সবকিছু করা সম্ভব। ঐ যে ছাত্রছাত্রীরা, তারা এই অ্যাপস এর মাধ্যমে সাহায্য সংগ্রহ করে, যা পুনরায় একইভাবে শ্রমিক অথবা গরিব পরিবারকে দান অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেয়া হয়। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে লেনদেনের কারণে তারা সম্পূর্ণই নজরদারির মধ্যে থাকে। বলা হয়ে থাকে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে চীনের প্রায় প্রতিটি নাগরিককেই সরকার নজরদারির আওতায় এনেছে। এর ফলে যদিও অপরাধের হার সাময়িকভাবে কমেছে এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তবে স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হয়েছে নিঃসন্দেহে। চীন দেশে পাবলিক পরিবহন যাতায়াত ব্যবস্থায় খুবই কঠোর নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। বিদেশি ভিজিটরদের পুরো শরীর স্ক্যানিং করা হয়, কোন ধরণের পানীয় বহন করার অনুমতি থাকেনা। নিত্যনৈমিত্তিক যে কোন উপকরণের প্রয়োজন হলে ফুটপাতের পাশে অবস্থিত ভেন্ডর মেশিন হতে কিনে নেয়া যাবে। ''উইচ্যাট'' ব্যবহারের মাধ্যমে সবকিছু ক্রয় করা সম্ভব। চীনের শহরগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সৃজনশীল অবকাঠামোয় পরিপূর্ণ। জনশ্রুতি আছে, অতীতে কোন এক শহরে কিছু সংখ্যক যুবক ও বৃদ্ধ নিয়ম করে শহরের একটি পার্কে সকাল-বিকাল কনসার্ট বাজিয়ে শারীরিক কসরত করত। এর অনুসরণে সরকার পরবর্তীতে প্রতিটি শহরেই উন্মুক্ত পার্ক, খালি জায়গায় কনসার্ট সিস্টেম বসিয়ে দেয়, যাতে যে কোন বয়সের নাগরিক, যেকোনো সময় শারীরিক কসরতে অংশ নিতে পারে। এর ফলে সকলের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ গড়ে উঠে এবং মন-মানসিকতা ও শারীরিকভাবে সতেজ থাকে। চাইনিজরা ঐতিহ্যগত ও পারিবারিকভাবে শারীরিক কসরতের সাথে পরিচিত। মার্শাল আর্ট ''কুংফু'' একটি ঐতিহ্যবাহী আত্মরক্ষামূলক কসরত। চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এক সময় মার্শাল আর্টের কসরত প্রচলিত ছিল এবং উঠতি বয়সি ছেলেরা পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় স্কুলগুলোতে ভর্তি হতো। চীনে সকল বয়সীদের কোন না কোন ভাবে চাকুরীর ব্যবস্থা রয়েছে। মোটামুটি প্রাপ্তবয়স্ক লোকজন শহর ও গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন রাখতে সহযোগিতা করে, যার বিনিময়ে 'উইচ্যাট' এর মাধ্যমে তাদের একাউন্টে অর্থ জমা হয়। মজার ব্যাপার হলো, চীনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নদী ও খালগুলোর আশেপাশে প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের আবর্জনা সংগ্রহের উপকরণ নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। মূলত তারা পানিতে প্রবাহিত ছোট-বড় যে কোন প্রকারের আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে নিয়োজিত। এর ফলে চীনের নদী-খাল, শহর-গ্রামগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। ঐ যে বললাম, সকল নাগরিক সেন্ট্রাল সার্ভার এর মাধ্যমে নজরদারির আওতাধীন, পাশাপাশি নাগরিকদের দায়িত্ববোধ ও সচেতনতাবোধ যে নেই, তা নয় কিন্তু। চাইনিজদের খাবার-দাবারের ভিন্নতা রয়েছে, যা হয়তো উপমহাদেশ ও পাশ্চাত্যের খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিলে না। তবে Chinese Food একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড নিয়ে বসে আছে। চীন ''আইটি'' সেক্টরে বিশ্বের অন্যতম। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই চীনের নাগরিক বা চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিক পাওয়া যাবে না। নিজেদের পরিশ্রম ও দক্ষতার কারণে তারা বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সমাদৃত। ''মঙ্গলয়েড'' পীতবর্ণ, কুতকুতে চোখ ও বোঁচা নাক, পাতলা ঠোটের এই জাতি দূরদর্শিতা বিবেচনায় অনেকটা ইহুদি জাতি গোষ্ঠীর মতো। কয়েকজন ইহুদি মিললে যেমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চিন্তা করে, তেমনি চাইনিজরাও বেকার থাকতে পছন্দ করে না। ধর্ম নিয়ে তাদের তেমন আধিখ্যেতা নাই (অধিকাংশই লোকজ আচার ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী), তবে শিষ্টাচার, নিজস্ব লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি পালনের বিষয়ে তারা দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান। ''ড্রাগন'' তাদের ধর্ম/সংস্কৃতি উভয় বিশ্বাস কিংবা মূল্যবোধের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং তারা ''চাইনিজ নিউ ইয়ার'' বেশ আড়ম্বর সহকারে পালন করে থাকে। দুর ইতিহাসে একটি সমৃদ্ধশালী চীনা জাতির অবস্থান সামষ্টিকভাবে বিবেচনা করা হয় অর্থাৎ একক ক্যারিশমাটিক ব্যক্তির অবদান আলোচিত হয়না। এর জন্য রক্ষণশীল, mystic সমাজ/রাষ্ট্র ব্যবস্থা দায়ী। তথাপি কনফুসিয়াস (একজন বিখ্যাত চাইনিজ দার্শনিক), বৌদ্ধ যাজক ও পরিব্রাজক ফা হিয়েন সাং প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। চাইনিজরা কিছু কুসংস্কার ও সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী। বিশ্বের সচরাচর লোকজন "১৩" কে ''আন লাকি'' মনে করলেও চাইনিজদের কাছে "৪" সংখ্যাটি অশুভ। কেন ? "৪" এর চাইনিজ উচ্চারণ 'ছিঁও' যা 'মৃত্যু' শব্দের উচ্চারণেও উচ্চারিত হয়। তারা '৬' ও '৮' সংখ্যাগুলো ভালো পছন্দ করে। হোটেলে রুম নাম্বার এর আগে ফ্লোর বিবেচনায় ১,২,৩ সংযুক্ত থাকে। অর্থাৎ ২য় তলার ২০ নং রুমকে ২২০ উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে চাইনিজরা উক্ত নাম্বারের সাথে বাড়তি '৮' যোগ করে '৮২২০' বলবে। চাইনিজ ভাষা পৃথিবীর অন্যতম একটি বিস্ময়। পর্তুগিজরা একে 'অফিসিয়াল ভাষা' বা মান্দারিন বলতো, যাকে প্রচলিত অর্থে ' চাইনিজ ভাষা' বোঝায়। প্রকৃতপক্ষে চাইনিজ ভাষাকে 'zhongguo yu' বলা হয়ে থাকে। মজার বিষয় হলো, সাধারণ চীনারা ''চীন'' কিংবা ''চায়না'' বলতে কিছু চেনে না। "চীন" এর প্রকৃত নাম zhong guo (it means "middle country" in the world, 'guo' means country), তেমনি বাংলাদেশকে "meng jia la guo'' , আমেরিকাকে "mei guo" (beautiful country) বলে। চীনাদের ভাষায় পৃথক বর্ণমালা নেই, সরাসরি এক একটি শব্দ দিয়ে প্রতিকী অক্ষর গঠিত। ৭০০০/৮০০০ বছর আগে এই শব্দমালার উৎপত্তি। আনুমানিক ৫০০০ বিভিন্ন প্রকারের শব্দ ও ১২০০ সুনির্দিষ্ট শব্দমালা রয়েছে। "হান" বংশের রাজা 'হান' চাইনিজ ভাষাকে পরিশোধিত করে আধুনিক রুপ দান করেন।চীনারা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও মহাকাশ গবেষণায় বেশ অগ্রসর হয়েছে। জাতিটি প্রযুক্তি গবেষণা খাতকে অতিরিক্ত গোপনীয়তায় রাখায় দীর্ঘদিন এ বিষয় সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মহাকাশ গবেষণায় দেশটির সাফল্য দেশ চমকপ্রদ। সম্প্রতি দেশটি মঙ্গলে ও চাঁদের অপর পিঠে মহাকাশযান পাঠিয়েছে এবং তার একটি বৃহৎ স্পেস ষ্টেশন 'তিয়াংগং' পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণ করেছে। 'কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলম্যান্ট' গবেষণায় দেশটি বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধন করেছে। সম্প্রতি তারা এর পদ্ধতিতে "বিনা সময়ে" একটি "তথ্য" পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। Copycat অর্থাৎ Reverse Engineering প্রযুক্তির বদৌলতে দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও অসামরিক সরঞ্জামাদি তৈরি করে "মেড ইন চায়না" নামের বিপণন করেছে। চীন একটি বিশাল দেশ। বিশাল জাতিগোষ্ঠী। রহস্যময় ও ঐতিহ্যবাহী অতীতের অধিকারী। চমকপ্রদ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এ সমস্ত কারণে একে "বিশ্বের মধ্যে আরেকটি বিশ্ব"ও বলা হয়ে থাকে।
Make sure you enter the(*)required information