চারিদিকে নিরব নিস্তব্ধতা। কারো মুখে রা নেই। যেন পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে গেছে যতসব ভাষা। ঠোঁট যেন আঁটা দিয়ে সাঁটা। ভীত হরিণীর মত চোখ দু’টো খোলা সবার। কেউ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আছে। কেউ দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে কি যেন ভাবছে। কেউ অন্যমনস্ক হয়ে দাত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। কেউ পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ অস্থিরভাবে পায়চারি করছে কক্ষের ভেতর-বাহির। কয়েকজন খাটের উপর আড়াআড়িভাবে বসে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কোমরে হাত রেখে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মেঝেতে অদৃশ্য আঁকিবুকি আঁকছে। উৎকন্ঠিত নানা ভঙ্গির মুখগুলো শুধু একজনের আগমনের অপেক্ষায়। যে আসার কথা ছিল আজ। দীর্ঘ দশ মাস ধরে চলছে তার আগমনের প্রস্তুতি। তবে আজ আসবে, এটা নিশ্চিত সবাই। কিন্তু, কখন আসবে? এত অপেক্ষা, এত যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। এরই মধ্যে একজন ‘ওমা....’, ‘মা-গো....’, বলে গোঙাতে লাগল। টলটল চোখে একজন সান্তনা দেয় -কিচ্ছু হবে না, আরেকটু অপেক্ষা কর। শোনে তার গোঙানি আরও বেড়ে যায় -‘আমি শেষ, আমি শে.......ষ। মা-গো তুমি কোথায়?’ পাশের জন ধমকের সুরে বলে, এই তো আমি, এই রকম করিস কেন? -‘আমি আ.....র পারছি না.....। মাগো....., ওমা..., আমি মরে যাচ্ছি।’ প্রলাপে-বিলাপে কক্ষের নিরবতা অক্ষুণ্ন রইল না। কেউ রুমাল বের করছে, কেউ টিস্যু বের করছে, কেউ চোখের ধুলা পরিষ্কারের ভান করছে, কেউ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পর মুখ দিয়ে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলছে, কেউ বা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ। তবু যার আসার কথা সে এল না। সাদা গাউন পরিহিতা একজন এসে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অক্সিজেন, ট্রলি, স্যালাইন- ইমার্জেন্সি। সাথে সাথে একজন ট্রলি আরেকজন অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে হাজির। অতিদ্রুত ‘ওমা’ ‘মাগো’ করুণ আর্তনাদগুলো স্থানান্তরিত হল একটি কাচ ঘেরা কক্ষে। কক্ষের চারপাশে নানান যন্ত্রপাতি। সবাই মুখোশধারী আর হাতে গ্লাভস। কাচের দেয়াল-দরজা ভেদ করে কোন আর্তনাদ ভেসে আসে না। আবারও নিরবতা। থমথমে পরিবেশ। যে যেখানে আছে, স্থির। কারও নড়াচড়া করার শক্তি যেন আর্তনাদের বানে ভেসে গেছে। এদের রুমাল, টিস্যু বের করার শক্তিও উবে গেছে। দাঁত চেপে ধরার কিংবা ঠোঁট কামড়ানোর শক্তিও। আচ্ছা, শক্তি কী জিনিস? একজনের আর্তনাদে কিভাবে এতগুলো মানুষের চলন শক্তি, নড়ন শক্তি, বাচন শক্তি, দর্শন শক্তি সব অচল হয়ে যায়? আর্তনাদও কি শক্তি? শক্তি শক্তিকে প্রভাবিত করে। প্রবল শক্তি দুর্বল শক্তিকে গ্রাস করে। এসব ভাবার সময় নেই। সবাই কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সবাই ভিড় করছে কাচঘেরা দেয়ালের পাশে। মনে হয়, সে এসেছে, যে আসার কথা ছিল। হ্যাঁ, তাই তো! নতুন কার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি। আরে আরে, এরা কান্না জুড়ে দিল যে! অতি আনন্দে বুঝি হাসির বদলে কান্না-ই আসে। এত আনন্দ তোর রাখবি কোথায়? দেখ্, ভাল করে দেখ্। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখ্। একবার, দুইবার, তিনবার- বারবার দেখ্। মন না জুড়ালে আবার দেখ্। কাছ থেকে, দূর থেকে, সামনে থেকে, পেছনে থেকে, উপর থেকে, নিচ থেকে, ডান থেকে, বাম থেকে উল্টে পাল্টে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখ্। অনেক অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে তার দেখা পেতে। সে এসেছে। সে নিজেই দিয়েছে তার আগমনী বার্তা। যদিও আমি তার ভাষা বুঝি না, তবুও তার আগমনী বার্তা আমি বুঝেছি। সবাই বুঝেছে। তার আগমনী বার্তার পর সব স্তব্ধ ভাষা চতুর্গুণে সচল হয়ে উঠেছে। তবুও সব কথা ছাপিয়ে, শুধু তার কথা-ই শুনা যায়, -ওঁয়ে, ওঁয়েঁ.......এঁ, ওঁয়েঁ.... ওঁয়েঁ...এঁহ্, ওঁয়েঁ।
Make sure you enter the(*)required information