হাঁটতে হাঁটতে হাঁটু ভেঙে পড়ার অবস্থা মাঝে মাঝে খালি রিকশা বেল দিয়ে যায় পাশ কাটার সময়। আমার মত অবশ প্রায় পথচারির ঢুলঢুলে হাটার ভঙ্গি দেখে যে কোন রিকশাওয়ালার মায়া হতেই পারে । কিন্তু কানের গোড়ায় এসে যখন বেল দেয় তখন বিরক্তিতে ইচ্ছে করে বেলটা খুলে সারাদিন রিকশাওয়ালার মাথায় ঘণ্টা বাজাই!একজন মধ্যবয়স্ক রিকশাওয়ালা তার খালি রিকশা নিয়ে আমার পাশ কেটে যাচ্ছিলেন। আমি ভাবলাম অন্য সবার মত সেও বেল দিবে! আমি তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি কখন সে বেল দিবে, আর আমি পারলে একটা কষে থাপ্পর দেব! সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত অপেক্ষা করছে, কখন আমি বলব- যাবেন? কথাটা আমার কাছ থেকে শুনতে না পেয়ে সে-ই বলল- কোথায় যাবেন বাবা! অবাক হলাম, যে কিনা বেল দিয়ে আমাকে বিরক্ত করার কথা, সে 'বাবা' বলে আমার মনটা গলিয়ে দিল! আমি চোখ বন্ধ করে না সূচক মাথা নাড়লাম, আর হাতের ইশারায় বললাম, আপনি যান! একটু পর সে বলল, বাবা আপনার ভাড়া দিতে হবে না, কোথায় যাবেন, উঠেন! আমি সরে গেলাম। ফুটপাতে পড়ে থাকা এক টুকরা ইটে বসে পড়লাম। সে রিকশা সাইড করে আর কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসল, বলল –বাবা, আপনার মত সন্তান আমারও আছে, ভার্সিটিতে পড়ে। আপনাকে দেখে ছেলের কথা মনে পড়ে গেল। ছেলের কাছ থেকে কি বাবারা টাকা নেয়? চল, কোথায় যাবে বল, তোমাকে পৌঁছে দেই।আমি চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে রাখলাম। এই রিকশাওয়ালা জানেই না, আমি সমস্ত রিকশাওয়ালার কাছে দাগী আসামী! আমি শঠ, আমি প্রতারক! চেহারা দেখে মানুষের পাঠ পড়া যায় না। যেমনি পারে নি চাঁদপুর থেকে আসা এক ছোকরা রিকশাওয়ালা। তার রিকশার প্রথম যাত্রী ছিলাম আমি। জানি না, আমার শঠতার কথা তার মনে আছে কিনা? আসলে সেদিন শঠতা করেছি কিনা, তা-ও আমি নিশ্চিত না! এখনও বুঝতে পারি না, সেদিন আমার নৈতিকতার খুঁটি নড়বড়ে ছিল কিনা?সেদিন সময় ছিল কম। প্রয়োজন ছিল বহদ্দার হাট যাওয়ার। প্যারেডের পূর্ব কর্নারে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ছোকরার রিকশায় লাফ দিয়ে উঠে বললাম, "বহদ্দার হাট জলদি!" ছোকরা বলল, "ভাইয়া আমি এই শহরে নতুন। বহদ্দারহাট চিনি না। আপনি পথ দেখিয়ে দিলে আমি পৌঁছে দেব। দূরত্ব না বুঝে ভাড়া বলতে পারতেছি না, রেট ভাড়া দিয়েন।"আমি ইশারায় সোজা চালাতে বললাম।একবারও ভাল করে তাকিয়ে দেখা হয় নি এই ছোকরা রিকশাওয়ালার চেহারাটা দেখতে কেমন? পিছন থেকে তার চুলের স্টাইল দেখে আন্দাজ করলাম, সে স্কুল পলাতক। পেটের দায়ে বা প্রেমিকার দায়ে রিকশা ধরেছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্যাডেল মারা আর সামনের চাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে, আজই সে রিকশা ধরেছে। জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়? বলল, চাঁদপুর।একসময় এমন কোন দিন যায় নি, যে দিন চাঁদপুরের নাম পত্রিকায় পড়ি নি। তবু চাঁদপুরের অবস্থান আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কল্পনার মানচিত্রের কোনখানে চাঁদপুর তা নির্ণয় করার চেষ্টা করছি, আর রিকশাওয়ালা ছোকরাকে আমার গন্তব্যের পথ নির্দেশ করছি।নতুন চাঁদগাও থানার মোড়ে রিকশা থামালাম। পাঁচশ টাকার নোট বের করে তাকে দিলাম, আর বললাম, বিশ টাকা নাও। সে বলল, ভাইয়া আমার কাছে ভাংতি নাই। আজকেই রিকশা নামিয়েছি, সকালবেলা আপনিই প্রথম যাত্রী। বললাম, দাঁড়াও তাহলে, আমি সৌদিয়া বাস কাউন্টারে গিয়ে টাকা ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসি। সে আমার দিকে তাকালো। করুণ সুরে বলল, ভাইয়া আমাকে ঠকাইয়েন না, আমি নতুন।আমি বজ্রাহতের মত কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। তার চোখের দিকে তাকিয়ে পড়ে দেখলাম তার ভয়, সংশয়, অসহায়ত্ব। শুধু সময় জ্ঞানটা আর বিশ্বাসটা পড়তে পারলাম না। আমি কাউন্টারে টাকা ভাঙাতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকা সৌদিয়া বাসের ড্রাইভারের কাছে গেলাম। অনুরোধ-উপরোধ করতে করতে সময় ক্ষেপন হল প্রায় দশ মিনিট। টাকা ভাঙিয়ে মোড়ে এসে দেখি ছোকরাটা নাই!সে কি ভেবেছে আমি তাকে ভাড়া না দেওয়ার জন্য বাসে উঠে বসে আছি? সে কি ভেবেছে, ভাড়া চাইলে আমি তাকে ধমকাবো, মারবো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার এখনও জানা হল না। জানি না কখনও জানা হবে কিনা। আমি টাকা ভাঙিয়ে ফিরে আসার আগেই সে চলে গেল, আর আমাকে প্রতারক বানিয়ে দিল। একটু অপেক্ষা করে তার ভাড়াটা নিয়ে নিল না।চাঁদপুরের সেই রিকশাওয়ালা আমাকে সমস্ত রিকশাওয়ালার কাছে প্রতারক বানিয়ে দিল।
Make sure you enter the(*)required information