জ্ঞানতাপস লেখক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, তাঁর ছাত্র বাংলাদেশের অপর এক প্রথিতযশা চিন্তাবিদ, লেখক ও সাহিত্যিক আহমদ ছফা এবং সাহিত্যিক আহমদ ছফার ছাত্র ইতিহাসবিদ, লেখক, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এই তিনজন বাংলাদেশের ইতিহাস, হাজার বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ নিয়ে যেভাবে গবেষণা করেছেন এদের কাছেই মূলত আমরা সঠিক ইতিহাস জানতে পারি। সলিমুল্লাহ খানের এই দুই গুরুর মুখের একেকটা বাণী যেন একেকটা বইকেও হার মানায়। সলিমুল্লাহ খানের সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করে আমিও বলতে চাই কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশে অনেক শিক্ষিত শ্রেণী, লেখক শ্রেণী তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু উনাদের একেকটা বই এক পাল্লায় রাখলে এবং অপর পাল্লায় যদি ড. আব্দুর রাজ্জাকের একটা বাণী রাখা হয় তাও আব্দুর রাজ্জাকের পাল্লা ভারী হবে। ড. মঈন উদ-দীন খানের বাণীও সত্যি আব্দুর রাজ্জাকের মতো। তাঁর প্রতিটি কথার মাঝেই নতুনত্বের ছাপ। নব ভাবনা, চিন্তা ড. মঈন উদ-দীন খানের মাঝেও দেখা যায়। উনার পিতার আদর্শকে ধারণ করে তিনি সুফিবাদকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। আধ্যাত্মিকতার মাঝে ডুবে গিয়ে মহান রবকে অনুসন্ধান করেছেন। তিনি জানার জন্য ভালো মন্দ বিবেচনা না করে আগে মানুষের সাথে মিশেছেন। তিনি জ্ঞানের অনুসন্ধান করতে দেওয়ানবাগী হুজুরের কাছেও গিয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে দেওয়ানবাগী ইতিবাচক ধিক তুলে ধরেছিলেন। কখনোই তিনি বিভেদ তৈরি করেননি। ড. সলিমুল্লাহ খান বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও বাংলা ভাষা, সাহিত্য সচেতন একজন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মানুষ। তাঁর মাঝেও খানিকটা আব্দুর রাজ্জাক, আহমদ ছফার চিন্তাভাবনার ছাপ দেখা যায়।ড. আব্দুর রাজ্জাক, আহমদ ছফা ও ড. সলিমুল্লাহ খান এই তিনজন ব্যক্তির জ্ঞান, গরিমার ধারেকাছেও আমি অন্য কোন ব্যক্তিকে দেখছি না। এদের নাম আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। যদিও সলিমুল্লাহ খানের জন্য আমরা আহমদ ছফা ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে চিনতে পেরেছি। এই তিনজন ব্যক্তির জ্ঞান, মেধা, চিন্তার সাথে আমি আরেকজন ব্যক্তিকে মিল পেয়েছি। তিনি হলেন সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের অন্যতম একজন ইতিহাসবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খান। এই মহান ব্যক্তি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অধ্যাপনার পেশায় যুক্ত ছিলেন। ড. খান যেসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েছেন সেসব প্রতিষ্ঠানকে তিনি এক অনন্য চূড়ায় নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যাংকিং খাতে এক বিশেষ অবদান রাখেন। ইসলামী ইতিহাস নিয়েও তিনি প্রচুর সাহিত্যকর্ম করেন। ড. আব্দুর রাজ্জাকের কাছে যেমন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আহমদ ছফা, সলিমুল্লাহ খানের মতো চিন্তাশীল মানুষেরা জ্ঞানার্জনের জন্য যাতায়াত করতেন তেমনি ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খানের কাছেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অনেক চিন্তাশীল, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষেরা যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। ড. খানের পাঠদানের ধরণ অন্যরকম। উনার লেকচার কেউ শুনলে সেখানে দ্বিমত কিংবা প্রশ্ন করে স্পষ্ট হবেন তো দূরের কথা। বরং উনার লেকচার দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। উনার যুক্তি, দর্শন এর বিরুদ্ধে যুক্তিখণ্ডন করার মতো দ্বিতীয় কাউকে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমনটা আমি ড. সলিমুল্লাহ খানের মাঝে দেখতে পায়। ড. সলিমুল্লাহ খান যখন কথা বলেন তখন তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকশ্রেণী, বুদ্ধিজীবীরা ছাত্রের মতো চুপচাপ থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। তিনি যেন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ও নিজেই একটা চলমান লাইব্রেরি। একই রকম কোয়ালিটি আমি ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খানের মাঝে দেখেছি। তৃতীয় কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আমার চোখে আর পড়েনি। এর পরে কাউকে স্থান দিলে সেটা আমার দেখা অন্য এক শিক্ষক ড. নিয়াজ আহমেদ খান স্যারকে দিবো। তবে ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খান হচ্ছেন অনেক উচুমানের একজন চিন্তাশীল মানুষ। তিনি যেসব ইসলামী দর্শন ও চিন্তাধারা, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন তার ধারেকাছেও দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি করেছেন কিনা সন্দেহ আছে। জানা মতে তিনি ১৮টির বেশি বই এবং ১০০টির মতো গবেষণাপত্র ও নিবন্ধ প্রকাশিত করেছেন। যদিও তিনি মানুষের অগোচরে নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। চুম্বক যেমন কাছে যে মেটাল পায় সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় তেমনি ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খানের কাছে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা চুম্বকের মতো বারবার লেগে থাকতে চেয়েছেন। তাঁর প্রতিটি গ্রন্থ, গবেষণাগ্রন্থ সব-কটিই একেকটা জ্ঞানভান্ডার! ড. সলিমুল্লাহ এর একেকটা লেকচার যেমন একেকটা বই তেমনি ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খানের একেকটা লেকচার যেন একেকটা বই। ড. মঈন উদ-দীন খান যখন কথা বলেন তখন মনে হয় তাঁর সামনে একটি লাইব্রেরি আছে আর তিনি লাইব্রেরি থেকে একেকটা বই খুলে কথাগুলো বলছেন। ড. মঈন উদ-দীন আহমেদ খান কেমন একজন সম্পদ সেটা আমরা অনেকেই এখন ঠের পাচ্ছি। ঠিক তদ্রূপ ড. সলিমুল্লাহ খানের মতো একজন পণ্ডিত হারিয়ে গেলে বাংলার হাজার বছরের স্বাধীনতা ও বাংলার হাজার বছরের সমাজের কথা শোনানোর মতো আর কেউ থাকবে না। ফলে আমরা যেমন ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা ভুলে গিয়েছি, ১৯৪৭ সালে বৃটিশের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের কথা যেমন ভুলে গিয়েছি ঠিক তেমনি একদিন হয়তো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথাও ভুলে যাবো। আমরা স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে শপথ নিয়েছিলাম তাঁর সামান্যতম শর্ত পূরণ করতে পেরেছি। আমরা স্বাধীনতার উদ্দেশ্যকেই ভুলে গিয়েছি। যাক সেসব কথা থাক।আমরা কেন এতো পিছিয়ে আছি জানেন? কারণ আমরা খুব তাড়াতাড়ি অতীত ভুলে গিয়ে খুব সহজেই আধুনিকতার করাল গ্রাসে ডুবে যায়। আমরা নতুনত্বকে খুব সহজেই আপন করে নিই। আমাদের মাঝে স্বতন্ত্র বলতে কিছুই আমরা আর অবশিষ্ট রাখিনি। আমরা ভাবতে বসেছি অন্যান্য দেশেরে স্বাধীনতা আর আমাদের স্বাধীনতা সমান। আমরা তাই তাদের দেখে অনুকরণ, অনুস্মরণ করছি। অথচ আমরা আমাদের ভাষাগত ঐতিহ্য, সামাজিল সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পারলে, বুকে আমাদের ইতিহাসকে লালন করতে পারলে আমাদের মাঝে দেশপ্রেম পুনরুজ্জীবিত থাকতো। আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে থাকতে পারতাম।উপরোল্লিখিত এই চার পাঁচজন প্রথিতযশা চিন্তাবিদ, শিক্ষককে আমি তথাকথিত শব্দ "বুদ্ধিজীবী" বলতে চাচ্ছি না। কারণ বুদ্ধিজীবী বললে উনাদের দিকেও সমালোচনার তীর ছুঁড়ে দেওয়া হবে। যদিও মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবুও আমাদের মতো মূর্খ্যদের এই জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমালোচনা অমানানসই।লেখকঃ এম. তামজীদ হোসাইন
Make sure you enter the(*)required information