লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামের কীর্তিমান পুরুষ, আরেক অনুসরণীয় সমাজ সেবক, অপরিসীম জ্ঞান ও মেধাসম্পন্ন, বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী আলেমেদ্বীন মৌলানা মুসলিম খাঁন চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার (অবিভক্ত সাতকানিয়া উপজেলা) চুনতি গ্রামে ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা ছিলেন সাতকানিয়া থানার অন্যতম জমিদার কমর আলী দারোগা। এই করম আলী দারোগার দ্বিতীয় পুত্র আবদুস সোবহান সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র মৌলানা মুসলিম খান। মুসলিম খানের পিতা মরহুম আবদুস সোবহান সাহেব একজন আলেম ছিলেন।
অল্প বয়সে পিতৃ বিয়োগ ঘটলেও আবদুস সোবহান সাহেব পড়ালেখা ক্ষান্ত হননি। স্বীয় প্রচেষ্টা ও পিতার পৈত্রিক জমিদারীর সুযোগে তিনি উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় চলে যান। ভারতে উচ্চ শিক্ষা শেষে তিনি তাৎক্ষনিক দেশে ফিরে আসেননি। বরং পিতার জমিদারীর মোহ ত্যাগ করে নিজের একক প্রচেষ্টায় কিছু একটা করার মানসে কলকাতায় করোয়া রোডে খান টী কোম্পানি নামে চা এর ব্যাবসা শুরু করেন এবং এই ব্যাবসায় তিনি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেন । মৌলানা আবদুস সোবহান সাহেব ব্যাবসার চাইতেও বেশি খ্যাতি অর্জন করেন বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন হিসেবে। সেই সূত্রে তিনি ১৯২১ ইংরেজ সনে চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অলিকুল শিরোমনি হযরত মৌলানা আবদুল হাকীম সাহেবের পুত্র খাঁন বাহাদুর ওয়াজি উল্লাহ সামীর নাতনী করম নিগারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯২৩ ইংরেজী সন থেকে চুনতি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
মাতামহ জজ ওয়াজী উল্লাহ সামী হলেন চুনতী হাকিমিয়া কামিল(এম.এ) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আবদুল হাকীম সাহেবের প্রথম পুত্র। মা-বাবার ২ পুত্র ও ৩ কন্যার মধ্যে মুসলিম খাঁন দ্বিতীয়। মুসলিম খাঁনের প্রথম বোন শামসুন্নাহার চুনতী নিবাসী মরহুম নুরুল আবছার সাহেবের স্ত্রী ও অ্যাডভোকেট মিনহাজুল আবরার এর মা। দ্বিতীয় বোন মিসবাহ মরহুম বদরুদ্দোজা(আমিন) এর স্ত্রী। তিনি মেজর জেনারেল মিয়া মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, পিএসসি, বীর বিক্রম এর মেঝ মামী। একমাত্র বড় ভাই মরহুম ইসলাম খাঁন যিনি একজন সমাজসেবক ছিলেন।
পিতার মতো মুসলিম খাঁনও একজন প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। শৈশবেই তাঁর বিকশিত মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। পিতার সার্বিক তত্ত্ববধানে তাঁর লেখাপড়া চলে। যুগশ্রেষ্ট শিক্ষকদের নেক নজরেই তাঁর উচ্চ শিক্ষা লাভ হয়। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে মুফতি মৌলানা ইব্রাহীম, মৌলানা মীর গোলাম মস্তফা, মৌলানা মোজাফফর আহমদ ও মৌলানা আবদুর রশিদ সাহেব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
অসাধারণ জ্ঞান গরিমার অধিকারী মুসলিম খাঁনের স্মরণশক্তি ছিলো অসাধারণ। তিনি চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় আলিম পর্যন্ত পড়ে এরপর ফাযিল পড়ার জন্যে গারাঙ্গিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মাদ্রাসায় পাঞ্জাবীর পরিবর্তে শার্ট পরিধান করার কারণে মাদ্রাসা থেকে তাকে বহিস্কারের কথা উঠলে পোষাক বিতর্কে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন যুগ শ্রেষ্ট আলেমেদ্বীন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আমিন উল্লাহ সাহেব। তিনি সিদ্ধান্ত নেন মুসলিম খান মাদ্রাসায় আর ক্লাস করবেন না । ক্লাস না করেই নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ১৯৫৪ সালে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ফাযিল চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনি ক্লাস না করেই নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এই পরীক্ষায় তিনি ১ম স্থান অধিকার করে সবাইকে চমকে দেন। এবং নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ফাযিল চূড়ান্ত পরীক্ষায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১ম স্থান ও অবিভক্ত পাকিস্তানে ৭ম স্থান অর্জন করে রেকর্ড রেজাল্টের মাধ্যমে তিনি তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।
উল্লেখ্য, তার এই অভূতপূর্ব ফলাফলের জন্য ২০২০ সালের ২রা জানুয়ারি গারাঙ্গীয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে তাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি ও পীরে কামেল হযরত শাহ মৌলানা আনোয়ারুল হক সিদ্দিকী সাহেব স্বহস্তে এই ক্রেস্ট প্রদান করেন।
কৃতিত্বের সাথে ফাযিল পাশ করার পর তিনি চট্টগ্রাম শহরের কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি এবং মহসিন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
১৯৫৯ সালে মৌলানা মুসলিম খান চট্টগ্রামে ইসলামীয়া লাইব্রেরীর মালিক বিশিষ্ট আলেম আলহাজ্ব মৌলানা শামসুল হুদা খান সিদ্দিকী সাহেবের ৩য় কন্যা রায়হা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তাঁর ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে বড় ছেলে হাবিব খান পিতার প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান হাবিব প্রিন্টিং প্রেস পরিচালনা করছেন। সিকদারপাড়া ছলিমুল উলুম এতিমখানা ও হেফজখানার নির্বাহী সদস্য মৌলানা মোজাম্মেল হক তাঁর বড় জামাতা এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলদেশ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আমির জাফর ছাদেক মুসলিম খান সাহেবের মেঝ জামাতা।
পঞ্চাশের দশকে তিনি রেডিও পাকিস্তান এর উর্দু সংবাদ পাঠক হিসেবে মনোনীত হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাঁর বড় ছেলে হাবীব খাঁনের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত "হাবিব প্রিন্টিং প্রেস" প্রায় পঞ্চাশ বৎসর যাবৎ সুনামের সাথে ব্যাবসা করে যাচ্ছে। এছাড়াও তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিল। তিনি চট্টগ্রাম মুদ্রাক্ষর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি , চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় প্রায় অর্ধশত বৎসর যাবৎ পরিচালনা পরিষদ এর সদস্য, চুনতি সীরাত (সঃ) মাহফিল-এ ১৯৭৩ হতে ২০০৭ সন পর্যন্ত পরিবেশন ও অর্থ বিভাগে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
উল্লেখ্য, তার এই অভূতপূর্ব ফলাফলের জন্য ২০২০ সালের ২রা জানুয়ারি গারাঙ্গীয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে তাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি ও পীরে কামেল হযরত শাহ মৌলানা আনোয়ারুল হক সিদ্দিকী সাহেব স্বহস্তে মুসলিম খাঁনের ছেলে সাজ্জাদ খাঁনের হাতে এই ক্রেস্ট তুলে দেন।
আরবী,ফার্সী,উর্দু, ইংরেজী, তফসীর , হাদিস , ফিকাহ, নাহু মানতিক সহ সর্ব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিলো অসাধারণ। আজীবন সামজিকতায় জড়িত এ মহাপ্রয়াণ ২০০৭ সনে ৭ অক্টোবর, ২৪ রমজান ১৪২৮ , ২২ আশ্বিন ১৪১৪, রোববার ভোর ৪-১০ মিনিটে মেহেদীবাগস্থ ন্যাশনাল হাসপাতাল লি. এ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একই দিন বাদ আসর চুনতী সীরাত (স.) ময়দানে তারই ওস্তাদ আলহাজ্ব হযরত মৌলানা আবদুর রশিদ সাহেবের ইমামতিতে জানাজা শেষে চুনতির ঐতিহ্যবাহী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ ১। মরহুম মৌলানা মুসলিম খাঁনের জ্যেষ্ঠ পুত্র জনাব হাবীব খাঁন।২। লেখক- হাফেজ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ, দৈনিক আজাদী পত্রিকা।
Make sure you enter the(*)required information