বাঙালি জাতির স্রষ্টার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত এজন্য যে, তারা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো একজন জাতীয় শিক্ষককে পেয়েছে। যিনি শুধু বাংলাদেশের নয় তাঁর সমসাময়িক বিশ্বের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল মানুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কালের পরিক্রমায় আমরা এই মহান শিক্ষককে ভুলে যেতে বসলেও তাঁর আদর্শের ধারেকাছেও কোনো বাঙালি শিক্ষক আজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তাঁর ক্ষুরধার জ্ঞান প্রতিভা, উন্নত দর্শনচিন্তা ও সর্বোপরি একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে তাঁর যে ভূমিকা সেই গুণ সত্যি অন্য কোনো বাঙালি শিক্ষকের মাঝে নেই। এই মানুষটির এতো উচ্চ জ্ঞান প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাঁর মাঝে আত্ম-অহংকারের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হয় সে তত বেশি বিনয়ী হয়। এই বাক্যের জলন্ত উদাহরণ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। বাঙালি শিক্ষক সমাজ যদি এই মানুষটির জীবনাদর্শকে সামান্যতম নিজেদের মধ্যে ধারণ জরতে পারতো তাহলে আজকে আমাদের শিক্ষার এই করুণ দশা হতে না। তাই বলে আমি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে মোটেও তলানিতে ফেলে রাখতে চাই না। বরং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র্যাংকিং এর যে অবস্থান সেটা থেকেই বুঝা যায় আমাদের শিক্ষার কি করুন দশা। যদি আমরা ক্যারিয়ারের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা দিতে সক্ষম তথাপি শিক্ষার মূল লক্ষ্য হাসিল করতে আমরা অক্ষম।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র ছিলেন বাঙালির অপর এক অনন্য সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী বুদ্ধিজীবী ও লেখক অধ্যাপক আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁকে গুরু হিসেবে মান্য করতেন। গুরুর সাথে কাটানো সময়ের মাঝে দীর্ঘ সময় ধরে অনেক বিষয়ে দু'জনের মধ্যে আলাপ হতো। আহমদ ছফা তাঁর গুরুকে যেভাবে দেখেছেন, গুরুর মুখে যেভাবে যা শুনেছেন সেসব গুরুত্বপূর্ণ কথায় পরবর্তীতে আহমদ ছফা তাঁর "যদ্যপি আমার গুরু" গ্রন্থে তুলে ধরেন। এই গ্রন্থকে একপ্রকার অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের জীবনীও বলা যেতে পারে। এই গ্রন্থটি আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের জীবদ্দশায় লেখা হলেও প্রথমে তিনি নিজের জীবনী লিখতে দ্বিমত পোষণ করলেও আহমদ ছফার বারবার অনুরোধ করার পর তিনি অনুমতি দেন। সত্যি কথা বলতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে জাতির সামনে এতো সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য একজন মানুষই যথাযোগ্য। তিনি হলেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা গুরুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শুধু গুরুর উচ্চারিত বাক্যের প্রতিধ্বনী তিনি করেননি, যখন প্রয়োজন হয়েছে তিনি গুরুর কথাকে ব্যাখ্যা করে মানুষের সামনে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে তিনি স্থাপন করেছেন, যখন আবার দেখেছেন যে আব্দুর রাজ্জাক ভুল কিছু করেছেন তিনি তখন প্রতিবাদও করেছেন। এখানেই গ্রন্থটির আসল উৎকর্ষ। বইটি পড়তে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বাঙলার বুকে এমন একজন প্রতিভাবান মানুষও থাকতে পারে। যাঁর সাথে তাঁর সমসাময়িক বিশ্বের অনেক পণ্ডিতদের সাথেও তুলনা করা হতো। এই বইটি প্রতিটি বাঙালির পড়া উচিত। কারণ আমার মনে হয় এই বই না পড়লে বাঙালি মানুষের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঠিক বীজ বপন হবে না। এই বইয়ে আহমদ ছফা তাঁর গুরুর প্রতিভা সম্পর্কে বলেন, "প্রফেসর রাজ্জাকের চরিত্রের প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি আমি সব সময়ে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করে আসছি, সেটি হল তাঁর নিজের দেশ, সমাজের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারবোধই প্রফেসর রাজ্জাককে অন্য সকলের চাইতে আলাদা করেছে।...রাজ্জাক সাহেব মনে-প্রাণে একজন খাঁটি সেক্যুলার মানুষ। কিন্তু বাঙালি মুসলমানসমাজের সেক্যুলারিজমের বিকাশের প্রক্রিয়াটি সমাজের ভেতর থেকে, বাঙালি মসলমানের সামাজিক অভিজ্ঞতার স্তর থেকে বিকশিত করে তুলতে হবে, একথা তিনি মনে করেন।"একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত সেটা জানতে হলে বেশিদূর পাঠ করার দরকার নেই। আহমদ ছফার লিখিত যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থ পাঠ করলেই একজন আদর্শ শিক্ষকের রূপ ধারণ করা সম্ভব। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের তাঁর সমালোচক মেধাবী ছাত্রের প্রতি অনুরাগের বদলে যে ভালোবাসা সেটা প্রতিফলিত হয়েছে যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থে। বর্তমান সময়ের অপর এক তীক্ষ্ণ মেধাবী শিক্ষক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী ড. সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমরা ইদানীং পরিচয় হচ্ছি। বাংলাদেশের টেলিভিশনের টক শো গুলোর জন্য তাঁকে আমরা চিনতে পারছি। অথচ এই মানুষটি ছিলেন ড. আব্দুর রাজ্জাকেরও ছাত্র। একাধারে তিনি আহমদ ছফারও শিষ্য। ড. সলিমুল্লাহ খান আহমদ ছফাকে গুরু মানেন। ড. সলিমুল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সমালোচনা করার পরও একমাত্র তাঁর জ্ঞান প্রতিভার জন্য তিনি আব্দুর রাজ্জাকের চোখে নির্দোষ ছিলেন। জ্ঞানী হওয়ার কারণেই তিনি আব্দুর রাজ্জাকের অনুরাগী না হয়ে ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। এমন দৃষ্টান্ত বর্তমান সময়ে নজিরবিহীন। যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থের একটি ঘটনা তুলে ধরলে বিষয়টি একদম সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।"রাজ্জাক স্যার একটা কথা প্রায়ই বলতেন। আমরা শিক্ষকেরা প্রতি বছরই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুণদের চাহিদা, চাওয়া-পাওয়ার খবর আমােদের মতো লোমচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়। এটাই হল শিক্ষক জীবনের সবচাইতে বড় ট্রাজেডি। তারপরেও রাজ্জাক সাহেবের চরিত্রের মধ্যে একটা আকর্ষণী শক্তি ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান বিভাগের দীপ্তমান ছাত্রদের তিনি চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতেন। কারও মধ্যে সামান্যতম গুণের প্রকাশ দেখলেও তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন৷ একবার আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারের চাকুরির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। আমার ধারণা তিনি আমাকে স্নেহ করেন। কিন্তু আমার জন্য সুপারিশ না করে তিনি মাদ্রাসা থেকে আগত এক ভদ্রলোকের জন্য সুপারিশ করেছিলেন এবং তাঁর চাকুরিটি হয়েছিলো। ভদ্রলোক আরব দার্শনিক আল মাওয়ারদির একটি লেখা আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দেখিয়েছিলেন। রাজ্জাক স্যার প্রায়ই আপসোস করতেন, আরবি ফারসি এবং সংস্কৃত পালি জানা লোকের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে দুর্লভ হয়ে উঠেছে৷ এই ভাষাগুলোর অভাবে ওরিজিন্যাল সোর্স ব্যবহার করার ক্ষমতা কারও জন্মাবে না৷ সেকেন্ড হ্যান্ড সের্স পর্যালোচনা করে যেসব গবেষণাকর্ম করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে বিস্তর অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে।
রাজ্জাক স্যার ব্যক্তিগতভাবে অঙ্কের শিক্ষক রমজান আলী সরদারকে পছন্দ করতেন এমন মনে হয়নি। কিন্তু তিনি তাঁর খুব প্রশংসা করতেন। সরদারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্র যিনি অক্সফোর্ডে র্যাংলার হতে পরেছিলেন। রাজ্জাক স্যার মনপ করতেন সরদার যদি তাঁর সাধনার প্রতি যত্নবান হতেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অঙ্কবিদদের একজন হতে পারতেন। সলিমুল্লাহ খানের বয়স আমার থেকে অন্তত পনেরো বছরের কম। সে রাজ্জাক সাহেবকে নির্জলা বকাঝকা করে আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছিলো। বইটি পড়ে শুধু আমি নই, রাজ্জাক স্যারের ঘনিষ্ঠদের অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সলিমুল্লাহ খান পুস্তক রচনা করে বসে থাকেনি। এক কপি নিজের হাতে লিখে বাড়িতে গিয়ে উপহার দিয়ে এসেছিলো। সাহস করে স্যারের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করিনি। একবার সলিমুল্লাহর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। দু'জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সার্টিফিকেট খুবই প্রয়োজন। তার মধ্যে একজন প্রফেসর রাজ্জাক, অন্যজন ড. কামাল হোসেন। সলিমুল্লাহ আমাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলো যেনো তাঁকে আমি স্যারের কাছে নিয়ে যায়। স্যারকে তো তাঁকে প্রশংসাপত্র দিতে হবে। অধিকন্তু ড. কামালের প্রশংসাপত্রও সংগ্রহ করে দিতে হবে। আমি বারবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সলিমুল্লাহ নাছোড়বান্দা। অগত্যা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে স্যারকে গিয়ে বললাম, কাল সকালে আপনার ওখানে নাস্তা করতে যাবো। স্যার বললেন, ঠিক আছে আয়েন। একথা বলে স্যার দাবা খেলায় মন দিলেন। আমি আবার স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, স্যার সলিমুল্লাহ খানও আমার সঙ্গে আসার বায়না ধরেছে। স্যার বললেন, ঠিক আছে লইয়া আয়েন। স্যার তখন একা থাকতেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা গুলশানের বাড়িতে চলে গেছেন। সলিমুল্লাহ খানের সাথে যথারীতি কথাবার্তা বললেন। কোন বিষয়ের ওপর গবেষণা করতে চায়, ও নিয়েও আলাপ করলেন। চলে আসার সময় সলিমুল্লাহকে বললেন, ঠিক আছে দুইদিন বাদে আয়েন। কাইল আমি কামাল হোসেনের কাছে যামুনে। সেবার সলিমুল্লাহর ক্যামব্রিজ যাওয়া হয়নি। কিন্তু রাজ্জাক স্যার নিজে প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন এবং ড. কামাল হোসেনের কাছ থেকেও প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিলেন।
কিছুদিন পর আমি স্যারের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম, সলিমুল্লাহর বইটি তিনি পড়েছেন কি-না। স্যার বললেন, হ পড়ছি। তাতে কী অইছে। ছেলেটার ত ট্যালেন্ট আছে। কী লিখছে না-লিখছে হেইডা মনে কইর্যা কী লাভ। হের ত কিছু করার ক্ষমতা আছে। হামিদাও আমারে একই কথা কইল। আমি যখন কামালরে কইলাম দুই লাইন কেইখ্যা দাও, হামিদা কয় হেই ছেলেটা না যে আপনার ওপর বই লেখছে? হেরে আমি ঘরে ঢুকবার দিমু না। আমি কইলাম, হেইডা কি একটা কথা অইল, একটা প্রমিসিং ছেলে, এমন কয়জন পাওন যায়, দাও দুই কলম লেইখ্যা। সলিমুল্লাহ যখন আমেরিকা গেলো, প্লেনভাড়ার টাকার এক অংশ রাজ্জাক স্যার দিয়েছিলেন। এখনও সলিমুল্লাহর খবরাখবর জানতে চান।"
Make sure you enter the(*)required information