সাজুর প্রিয় স্ত্রী মিলা, ছেলে সাবাব, মেয়ে দুটো রুমি ও ঝুমি সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে গেলো আজ তিনদিন। অফিস থেকে এসে হালকা নাস্থা করে ঘরে একা একা গীতাঞ্জলীর পাতায় চোখ রেখে সাজু আবৃত্তি করছিলো। “আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে । বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে । একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে, সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে । বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে ।“ এমনি এক সময়ে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের কালো অন্ধকার নেমে এলো। প্রকৃতির চারিদিকে সুনশান নীরবতা।মাঝে মাঝে হঠাৎ বাতাসের ঝাপটা।আশে পাশের গাছগুলো দুলছে, কখনো ডানে, কখনো বামে এলোমেলো।জানালার পাশে সোফায় বসে ঠান্ডা বাতাসের শিহরণ অনুভব ওর মনে জানান দিলো আজ বৃষ্টি আসবে। বিশ্ব কবি নোবেল বিজয়ী রবি ঠাকুরের লেখা কবিতার পড়তে পড়তে আজ মিলার কথা খুব মনে পড়ছে।অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ওদের সাথে গ্রামের বাড়ীতে গেলেই ভালো হতো।সাজু ও মিলার বিয়ে হয়েছে আজ আট বৎসর।প্রতিটি বর্ষায় সাজু আর মিলা খোলা নীল আকাশের নীচে বৃষ্টিতে ভিজে।বর্ষায় সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যায়।সবমিলে ওদের সুখের সংসার। আনমনা সাজু পড়ছিল “হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল ; সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল । আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি, কোন্ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে । বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে ।” কাজের ছেলেটা একটু আগে বেরিয়ে গেছে।বাজার করবে।বাসায় কেউ নেই।বাইরের লাইটপোষ্টে সিটিকর্পোরেশন এর বাতিটির আলোতে বৃষ্টির রেখা দেখতে পেলো।হ্যাঁ আজ অঝোরে বৃষ্টি নামবে।বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। হঠাৎ লোডসেডিং।অনেকক্ষণ বিদ্যুৎ নাই কি আর করা। সাজু গরমে সোফায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলো। একটু তন্দ্রা ভাব এলো। দরজা খোলার হালকা আওয়াজ ।কেমন যেন একটু ঠান্ডা অনুভূতি হলো। গরমে অন্যরকম ভালো লাগা অনুভুতি।হঠাৎ ঘরে সুন্দর একটা সুবাস। সুবাসটি সাজুর খুব পরিচিত একজনের।যেন সেই প্রিয় কাঠালী চাপাঁর গন্ধ। সাজুর বুঝতে দেরী হলোনা ওর ঘরে কে এসেছে। তবুও হেয়ালি করে সাজু জানতে চাইলো কে তুমি এখানে? কে আমার ঘরে? দরজাটা আর একবার দুলে উঠে অন্য পাশে গিয়ে পড়লো। কোন জবাব নাই অপর পক্ষের নীরবতা। দু পক্ষের কয়েক মূহুর্তের অপেক্ষা। একটু পরেই খুব পরিচিত মেয়েলী কন্ঠে জবাব এলো। আমি। সাজু ভ্যাবাচাকা খেলো, ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো আমি মানে তুমি? আমার ঘরে কখন এসেছো? কিভাবে এলে? তোমার ঘরের দরজা দিয়ে এসেছি। কেন দরজাতো খোলাই ছিলো । সাজু আমি মানে, আমি শিলা। আমাকে চিনতে পারছোনা? আমি শিলা। তোমাকে চিনবোনা কি বল? সেই প্রিয় সুবাস আমাকে জানান দিয়েছে আর মনে করিয়ে দিয়েছে সেই চল্লিশ বৎসর আগের কথা। শিলা? তুমি দেশে কখন এলে? রাস্তার লাইটের কিছুটা আলোর কিছুটা এসেছে সাজুর বসার ঘরে। শিলার পড়নে শাড়ি।সাজু শাড়ির রংটা বুঝে উঠতে পারছেনা। সাদা কালো শাড়ি। শিলা তুমি এখানে এতোদিন পর। হ্যা আমি।তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হলো তাই এসেছি। অনেক দিন পর এলে।এতোদিন কোথায় ছিলে? শিলা হঠাৎ আনমনা। ও আমি এতোদিন দেশের বাইরে ছিলাম।আজ একমাস হতে চললো ছোট খালার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দেশে এসেছি।খালাতো বোনের বিয়ে নিয়ে খুব ব্যাস্ত ছিলাম।গতকাল বিয়ের ধুমধাম শেষ হলো। সামিরের কাছ থেকে তোমার বাসার ঠিকানা নিয়েছি।আগামি কাল চলো যাবো তাই তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। শিলা তুমি এলেতো এতোদিন পরে? কি আর করা সাজু ইচ্ছা হলেও আসতে পারিনি। সামির বললো মিলা আর তোমার সুখের সংসার। আমি চাইনি তোমাদের কোন ক্ষতি হোক। কিন্তু দু একদিনের মধ্যে ফিরে যাব জার্মানে। সময় খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হল, তোমার চল্লিশ বৎসর আগের সেই সোনালী সময়। সেই কিশোর যৌবনের সোনালী দিনগুলোর কথা। একসাথে ঘুরে বেড়ানো ,গানের আসর , বত্তৃতা,বিতর্ক। লিচু বাগানে সময় কাটানো সেই স্মৃতি। ডাক বাংলার মাঠ চষে বেড়ানো আর মেঠো পথে বাড়ি ফেরা। বৃষ্টিতে তোমার ছাতায় একসাথে বাড়ি ফেরা। সারা পথে তুমি ছাতা ধরে রাখতে আমার মাথার উপর। একদিন স্কুল ছুটির পর। চুনতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে চায়ের দোকানের পিয়াজু ,গুলগুলা আর চা পানের পর হঠাৎ বৃষ্টি।দৌড়ে গর্জন গাছের নীচে আমি ও তুমি। তোমার সেই প্রস্তাব একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা আর জীবনের বাকি পথ একসাথে চলা। আর কেন জানি হঠাৎ আমার কি হলো? মনের অজান্তেই কিংবা ভুলে তোমাকে না বলা। এই আষাড়ে দেশে আসার পর ভীষন ইচ্ছে হলো বৃষ্টিতে ভিজতে। তোমাকে সেই সময়ে না বলাটা আমার জীবনের বড় ভুল ছিলো।তাই অপেক্ষায় ছিলাম।যদি বৃষ্টি আসে একটা দিন আমরা দুজনে একসাথে ভিজবো। আজ বৃষ্টি এলো।বৃষ্টি আমার সেই প্রতিক্ষীত বৃষ্টি এসেছে।তাই দেরী না করে তোমার ঘরে এসেছি।ঠান্ডা বাতাস খেললো। ঝুমঝুম বৃষ্টি নামছে। শিলা বললো সাজু আর কথা নয়। চলো হাটি পায়ে পায়ে, হাতে হাত রেখে । আজ শুধু আমরা দুজনে পাশাপাশি অবগাহন করি বৃষ্টিতে, আমাদের ভুলকে করি জয়। বৃষ্টির শীতল পরশে ছুয়ে যাচ্ছে আমার শরীর আর তোমার স্পর্শ, আমার হৃদয়। হঠাৎ কিসের একটা শব্দ হলো। কার যেন আওয়াজ।কাজের ছেলে কাদির চিৎকার করছে স্যার উঠেন।বৃষ্টিতে নিজে ভিজেছেন।সোফাটাও পুরো ভিজে গেছে।জানালাটা বন্ধ করতে পারলেননা।ম্যাডাম আইসা আমাকে বকবেন।স্যার মনে হয় ভাল একটা ঘুমদিলেন। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরইতো দমকা হাওয়া শুরু হলো।বাজারে পৌছানোর পরই ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি।সবাই ভিজছে আমিও ইচ্ছামত ভিজলাম।ভিজতে ভিজতে বাসায় আসলাম।আর আপনিতো বাসায় বসে পুরো ভিজে গেলেন।চলেন গরম গরম চা খাই আর গরম সিঙ্গারা ও পিয়াজু এনেছি।সাজু কাদিরকে কিছু না বলে সোফায় উঠে বসলো। সাজুর মনটা ভীষন খারাপ হলো। ভেজা সোফার জন্য নয়। স্বপ্নে দেখা দশ বৎসর আগে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া, সেই প্রেম সেই অনুভূতি প্রিয় শিলার জন্য। (গল্পটা আগে লেখা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পট ভূমিকায়, আজ চুনতি উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা জুড়ে দিলাম। পুরোটাই কল্পনা আর বাস্তব জীবনের কিছু ঘটনা)
Make sure you enter the(*)required information