চট্টগ্রামের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত উচু নিচু পাহাড়ে বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবদ্ধ এক সবুজ শ্যামল গ্রামের নাম চুনতী। চুনতী জনপদটি বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত এক গ্রাম। যে গ্রামটি যুগে যুগে শিল্প সংস্কৃতি লালনের এক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জনগণের কাছে স্বীকৃতি প্রাপ্ত এক গ্রামের নাম। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া বাংলাদেশের ভূখণ্ড নির্ধারিত হওয়ার বহু আগে থেকেই শতাব্দীকাল অতীতের ইতিহাসে সমৃদ্ধ একটি গ্রাম হিসেবে সুপরিচিত লাভের পেছনে যে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই জনপদের মানুষের মধ্যে একটা অসম্ভব রকমের আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। এমন কি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই গ্রামের মানুষের মধ্যে বয়সভেদে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সুদৃঢ় রয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় ঠিক তেমনি চুনতী গ্রামের মানুষের মধ্যে ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক না হয়ে গ্রাম কেন্দ্রিক গভীর ভালোবাসা গড়ে উঠেছে। মূলত এই সুসম্পর্কের জন্যই এই গ্রামের মানুষের মাঝে এক ব্যতিক্রমধর্মী সঙ্গীতচর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। যে সংস্কৃতিক চর্চার জন্য নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও এই গ্রামের মানুষেরা একটি উঁচুমানের সঙ্গীতের চর্চা করে যাচ্ছেন যুগের পর যুগ। যে সঙ্গীতের নাম দিয়েছেন শেরখানি। ঠিক কোন যুগ থেকে এই বিশেষ সঙ্গীতের পরিবেশন শুরু হয়েছে তা দিনক্ষণ বলা মুশকিল। তবে এই সঙ্গীতের যারা চর্চা করেন তাদের বয়স বিবেচনা করলে এবং তাদের ভষ্যমতে এই গানের চর্চা তাদের পূর্বসূরীদের থেকে তারা পেয়েছেন বিধায় এই সঙ্গীত চর্চার সময়কাল বলা বেশ কঠিন ব্যাপার।চুনতী জনপদটি আধ্যাত্মিক সাধক, হক্কানি পীর আউলিয়ার জন্মভূমি। এই জনপদে যুগে যুগে বহু জ্ঞানী, গুণী, আলেম উলামারা জন্মগ্রহণ করেছেন। আধুনিক শিক্ষার এক অনন্য পরিবেশ গড়ে উঠেছে এই গ্রামে। এমন একটি শিক্ষা কেন্দ্রস্থল পৃথিবীর কোথাও আছে কি-না আমার জানা নেই। তবে উপমহাদেশে অন্তত এতো সুন্দর মনোরম পরিবেশে শিক্ষাদান করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় হয়নি। স্বয়ং প্রকৃতি যেখানে এই চুনতী গ্রামকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে সেখানে এসব প্রশ্ন নিছক।শেরখানি একটি বিশেষ কালচারাল নাম। যেটা পৃথিবীর কোথাও আছে কি-না জানি না। তবে এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী সঙ্গীতের আসর আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে কোথাও দেখিনি। সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্মভূমি এই চুনতী। আমার মাতৃলয় চুনতীর এই সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। মাতৃলয়ে আমার জন্ম হয়েছে। সেই শৈশব থেকেই এই শেরখানি দেখে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। শেরখানি মূলত আনন্দ অনুষ্ঠানে সমবয়সীরা মিলে একই রকমের গান যৌথভাবে পরিবেশন করা। স্বর্ণযুগের গানসমূহ সমস্বরে কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়া পরিবেশিত হয়ে থাকে। এমনকি মেয়েদের মধ্যেও যারা সঙ্গীতপ্রেমী তারাও এই গানের আসরে যোগ দিয়ে থাকেন।একটি আনন্দঘন মুহুর্তে বিশেষকরে বিবাহ অনুষ্ঠানে, গায়ে হলুদের রাতে অনেক রাত পর্যন্ত বিয়ে বাড়িকে মাতিয়ে রাখেন এই শিল্পী সমাজ। এই গানের চর্চা কখন যে চুনতীর সামাজিকতার অংশ হিসেবে রূপ নিয়েছে এই জনগোষ্ঠীরাও বুঝে উঠতে পারেনি। এমনই একটি সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে এই শেরখানি। এমনকি দূর দূরান্তে যারা চাকরিবাকরি করেন তারাও এই সঙ্গীতের টানে বাড়ি ফিরে আসেন।শেরখানির পাশাপাশি এই এলাকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুবাদে ইসলামিক গানসমূহের চর্চাও করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে উর্দু সঙ্গীতের প্রতি এই এলাকার মানুষের একটা বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু এই অঞ্চলে উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত ও প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। এই মাদ্রাসাতেই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হয়ে থাকে। তাছাড়া আধ্যাত্মিক সাধকদের সংষ্পর্ষে এই ভাষার নাতে রাসুল, গজল এই অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। এর বাইরে আরো একটি তথ্য দিলে পাঠকরা চমকে উঠতে পারেন। সেটা হচ্ছে এই অঞ্চলের এমন অনেক লেখকরা রয়েছে যাদের রচিত উর্দু গজল, কালাম পুরো জগৎ বিখ্যাত। বর্তমান সময়ের এমন একজন ব্যক্তির নাম বলতেই হয়। তিনি হলেন চুনতীর কৃতি সন্তান সাকিব কিবরিয়া যিনি দিলকাশ চাটগাঁমী চুনতী নামে সুপরিচিত। যার লেখা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা গেয়েছেন। যুগে যুগে উনার মতো অনেকেই এভাবে উর্দু সঙ্গীতের চর্চা এই অঞ্চলে করেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমবয়সী ঐতিহাসিক আশেকে রাসুল শাহ সাহেব কেবলা (রহ.) এর প্রবর্তিত চুনতী মাহফিলে সীরতুন্নবীকে কেন্দ্র করে এসব ধর্মীয় সঙ্গীত এই অঞ্চলে চর্চা হয়ে থাকে। চুনতীর ঐতিহাসিক এই সঙ্গীতকে জীবন্ত করে রাখতে চুনতী ডট কম বিশেষ কিছু কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে এসব সঙ্গীতের আর্কাইভ গড়েছেন। যেখানে এসব সঙ্গীত সংরক্ষণ হবে। তবে এই সঙ্গীতকে চির অমর করে রাখতে হলে এর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গৃহীত হওয়া উচিত। না হয় কালের স্রোতে ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে এই পুরাতন ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে পারে। মনে রাখা উচিত গান হচ্ছে সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান৷ তাই একটি এলাকার সংস্কৃতি টিকে থাকে তার গানের মাধ্যমে।
Make sure you enter the(*)required information